উদ্দেশ্য : চোরধরা। হিচকক কায়দায় কেম্পেগৌড়া টাউনের নিশাচর দুবৃত্তকে ধরতে হবে। ধরা যদি সম্ভব নাও হয়, চোরের শারীরিক বর্ণনার বৃত্তান্ত ফাঁড়িতে পৌঁছে দিলেও কাজ হয়ে যাবে। চোর মহাপ্রভু নিশ্চয় সুচতুর। বয়স্কদের দেখলেই ঝোপের আড়ালে লুকোয়। ছেলে ছোকরা দেখলে পরোয়া করবে না। লুকোতেও যাবে না। সুতরাং
সামনে পরীক্ষা। তাই বাকি তিন সদস্য সন্ধের পর বাইরে থাকতে রাজি হল না। শ্যামলেন্দু নিমরাজি হল। দুই বন্ধুতে বেশ কয়েকদিন সাইকেলে করে রোদে বেরোল কেম্পেগৌডা টাউনের রাস্তায় রাস্তায়। তারপরেই একটা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটল।
রাস্তার মাঝেই ওদের পথ আটকালো একটা পুলিশ ভ্যান। রাস্তার মাঝেই শুরু হল জবাবদিহি করার পালা। কোন এক ব্যাঙ্ক ম্যানেজার নাকি অভিযোগ করেছেন–অদ্ভুতদর্শন দুটি ছেলে রোজ তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে সাইকেল করে যাতায়াত করছে। তাদের চাহনি চোরের মতো, গতিবিধিও তাই।
তাই হাতেনাতে ওদের পাকড়াও করেছে। শ্যামলেন্দু বেচারি কেঁদে ফেলে আর কী। ললিতমোহন ভয়ের চোটে সমস্ত কবুল করে বসল। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই যে লোহার কোট ডিটেকটিভ ক্লাবের সদস্যরা রাস্তায় বেরিয়েছে, শোনবার পর অট্টহেসে ওদের ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ। তবে নামধাম লিখে নিয়েছিল এবং কথা আদায় করেছিল–পরীক্ষার পড়া ফেলে আর ডিটেকটিভগিরি করবে না।
কেম্পেগৌডা তদন্তের ইতি হয়ে গেল সেইদিনই। মনকষাকষি ঘটল শ্যামলেন্দুর সঙ্গে ললিতমোহনের। ললিত চেয়েছিল পুলিশের চোখের আড়ালে কাজ চালিয়ে যাবে! শ্যামলেন্দু বেঁকে বসেছিল। ফলে মাসখানেক বন্ধ ছিল বাক্যালাপ এবং মুখদর্শন।
পরশুদিন আচম্বিতে বাড়ি বয়ে এল ললিতমোহন। শ্যামলেন্দু তো অবাক!
ললিত বললে, কেম্পেগৌডা নিশীথ রহস্যের সমাধান বলতে গেলে এখন তার হাতের মুঠোয়। আর একটু কাজ বাকি আছে। পরের দিনই একজনের সঙ্গে দেখা করে কেসটার ওপর যবনিকা টানবে সে। তদন্ত-ফল শুনলে পুলিশ নাকি লাফিয়ে উঠবে।
লোকটা কে, তা বলেনি ললিতমোহন। শ্যামলেন্দুও যেচে জিগ্যেস করেনি–জবাব পাবে না বলেই।
.
গতকাল পাঁচটার সময়ে ফের এসেছিল ললিত! টিনের টফি বাক্সটা শ্যামলেন্দুকে রাখতে বলেছিল। রহস্যের চাবিকাঠি নাকি ওর মধ্যেই আছে।
আজকে পুলিশ দেখে তাই ঘাবড়ে গিয়েছিল শ্যামলেন্দু। নিশ্চয় ললিত ফেঁসে গিয়েছে। এই আশঙ্কায় দৌড়ে গিয়েছিল গ্যারেজে। টিনের বাক্সটা ছিল গ্যারেজেরই আলমারিতে। ললিতই রাখতে বলেছিল। তাড়াতাড়ি সাংকেতিক হরফে লেখা কাগজ তিনটে বার করে ছেঁড়া কাগজে মুড়ে চালান করেছিল আলমারির পেছনে। খালি বাক্স রেখেছিল মোটরের বুটিতে।
ইন্দ্রনাথ আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে দেখেই ইচ্ছে করেই বুটির দিকে আড়চোখে চেয়েছিল শ্যামলেন্দু যাতে খালি টিনটা নিয়েই পুলিশ সন্তুষ্ট হয় এবং আসল কাগজগুলো থেকে যায় ললিতমোহনের জন্যে।
ফাঁদে পা দিয়েছিল ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
.
রাখলরাজ সাহার গোলাপ ভবন থেকে সটান মর্গে এসে পৌঁছোল ইন্দ্রনাথ আর প্রেমাংশু। ডক্টর ডিকসিট তখন লাশকাটার ঘরে।
পোর্সিলেন টেবিলে শুয়ে আছে ললিতমোহন। চুল কাটার সেলুনে চেয়ার সংলগ্ন হেডরেস্টের মতো মাথা রাখবার জায়গায় আলতো করে রাখা মাথাটা।
ডক্টর ডিকসিট চিন্তা-আবিল চোখে চেয়েছিলেন দগদগে ক্ষতস্থানগুলোর পানে। জোরালো আলোর নীচে ঈষৎ উন্মুক্ত অধরোষ্ঠের মতো হাঁ হয়ে রয়েছে কাটাগুলো। যেন অদন্ত শিশুর হাসি। চামড়ার ঠিক নীচের স্তরে চর্বির সাদা স্তরগুলো যেন দন্তহীন মাড়ি।
এমন সময়ে ঘরে ঢুকল প্রেম আর ইন্দ্র।
চোখ তুলে চাইলেন বৃদ্ধ ডাক্তার। ইন্দ্রনাথকে গত রাতে গাছতলায় দেখেছিলেন। এখন দেখলেন দিনের আলোয়। মনে মনে ভাবলেন, রবিশংকরের ভাই নাকি? বগলে সেতার কোথায়?
প্রেমাংশু শুধোল–কী পেলেন?
ললিতের পা দুটো ঈষৎ ফাঁক করে ধরে ঊরুর ভেতর দিকে একটা বড়রকমের কাটা। দেখালেন ডাক্তার–দেখেছেন? সারা গায়ে অনেক কোপ আছে। কিন্তু এই কোপটা অনেক স্পষ্ট।
অর্ধচন্দ্রাকারে উরু ঘিরে মাংস দু-ফাঁক হয়ে গিয়েছে এক কোপে। ডাক্তার বললেন–অস্ত্রটার ধরন আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি। কিছু ধরতে পারছেন?
না।
আমিও না। ঊরুর এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত এক কোপে সমকোণে সমানভাবে কাটতে পারে এমন কোনও ছুরি কখনও দেখিনি। অদ্ভুত! একটু থেমে–ঠিক আছে, পুরো চামড়াটা কেটে নিয়ে দেখা যাক।
স্ক্যালপেল তুলে নিলেন ডাক্তার। দক্ষ হাতে চামড়া কেটে ক্ষতস্থানকে তুলে আনলেন একটা ছোট্ট ডিসের ওপর। এতক্ষণ যা অর্ধচন্দ্রাকারে ছিল, এখন তা চ্যাপ্টাভাবে রইল। হাতিয়ারের বিচিত্র বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়ে উঠল জোর আলোর তলায়।
প্রেম আর ডাক্তার দুজনেই চোখ নামিয়ে আনল ডিসের কয়েক ইঞ্চি ওপরে। অদূরে বুকের ওপর দু-হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।
প্রেম বললে–ছুরির ফলাটা দেখছি সত্যিই বেঁকানো। নেপালি কুকরি, না, আরবি ছোরা?
মনে হয় না। ওসব ছুরির ডগা ক্রমশ সরু হয়ে আসে। আগা মোটা–ডগা সরু হয়। কিন্তু কাটা-টা দেখেছেন? আগাগোড়া সমান গভীর। ফলাটা সত্যিই খুব চ্যাটালো অমন ফাইন কোপ পড়েছে সেই কারণেই।
কপাল কুঁচকে ভাবতে লাগল প্রেম। ডাক্তার বললেন–চোটগুলোর প্যাটার্ন থেকেও ধরতে পারছেন না?