- বইয়ের নামঃ লোহার কোট
- লেখকের নামঃ অদ্রীশ বর্ধন
- বিভাগসমূহঃ অপরাধ
দেশে-দেশে ঘুরতে
আমি ভালোবাসি দেশে-দেশে ঘুরতে, ভালোবাসি দেশ-বিদেশের বই পড়তে। আমি ভালোবাসি নানান দেশের সাহিত্যের মালঞ্চ থেকে ফুল সংগ্রহ করে মনের সুতো দিয়ে মালা গাঁথতে। আমি ভালোবাসি জীবনের ঘটনায় কল্পনার পাল তুলে দিয়ে মন-পবনের নাওয়ে ভাসতে এবং পাঠককে ভাসাতে। আমি ভালোবাসি প্রিয় বন্ধু ইন্দ্রনাথকে চাঞ্চল্যকর কাহিনির নায়ক সাজিয়ে রোমাঞ্চ-দরিয়ায় অবগাহন করতে। আমি ভালোবাসি এমনই অনেক কিছু কিন্তু ভালোবাসি না কোনও কিছুরই প্রভাবকে অস্বীকার করতে। ঋণী আমি স্রষ্টার কাছে, জীবনের কাছে, মানুষের কাছে।
লোমহর্ষক এই কাহিনি এই সব কিছুরই ফলশ্রুতি। শিহরন এর লতায়-পাতায়, উৎকণ্ঠা আনাচে-কানাচে, রহস্য অলিতে-গলিতে! বয়স যাদের অপরিণত, সাহস যাদের অপ্রতুল, স্নায়ু যাদের দুর্বল, বিভীষিকা যাদের হৃৎকম্পের কারণ–এ কাহিনি তাদের কাছে নিষিদ্ধ।)
ইন্দ্রনাথ রুদ্র ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিল অভ্র কেলেঙ্কারির গোপন ঘাঁটির সন্ধানে। সে কেস মিটতে না মিটতেই জড়িয়ে পড়ল একটা অত্যন্ত নৃশংস হত্যারহস্যে।
রাত তখন নটা।
প্রেমাংশুর গান্ধীনগরের ফ্ল্যাটে বসে জিনিসপত্র গুছোচ্ছি আমি, কবিতা আর ইন্দ্রনাথ। পরের দিন সকালের বাসে মাইশোর যাব। সেখান থেকে উটি।
এমন সময়ে থানা থেকে ফোন করল প্রেমাংশু।
এখুনি চলে আয়। সেক্স মার্ডার! বীভৎস!
প্রেমাংশু আমার আর ইন্দ্রনাথের সতীর্থ। ভীষণ কালো, ভীষণ লম্বা, থ্যাবড়া নাক, পুরু ঠোঁট। মাথায় এবং কানে কুঁচকোনো চুল। সব মিলিয়ে নিগ্রো-নিগ্রো চেহারা। আমরা ওকে নিগ্রো বলেই ডাকতাম। ওর রাগ ছিল না। প্রেমাংশুর জন্ম এই ব্যাঙ্গালোরেই। শৈশব থেকেই কানাড়া ভাষায় চোস্ত। তাই প্রাদেশিকতার প্রাচীর ডিঙিয়ে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে এখানকার পুলিশ মহলে।
এখন ও মাইশোর পুলিশের বড় অফিসার। ব্যাচেলর। খুনে-গুন্ডারা ওর চেহারা দেখে আঁতকে ওঠে, ওপরতলা ভয় পায় ওর বচনকে। মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স আর ফরেনসিক সায়ান্স ওর কণ্ঠস্থ। প্রেমাংশু দিলখোলা। সেই কারণেই বড় দুর্মুখ।
অভ্র কেলেঙ্কারির জট ছাড়াতে প্রেমাংশুই আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইন্দ্রনাথকে। সে কেস সাঙ্গ হতে না হতেই ফের ডাক পড়ল লোহার কোট মামলায়।
পুলিশ ফাঁড়ি। অধিকারী থানাদারের ঘর। রেকসিন-ছেঁড়া টেবিলের পাশে ঘটোৎকচ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রেমাংশু। হাঁড়িমুখের ভাঁটা-চোখ দিয়ে যেন দগ্ধ করছে সামনে উপবিষ্ট যুগলমূর্তিকে।
মেয়েটির মুখে আড়ষ্ট ভয়ার্তি। চাহনির মধ্যে শূন্যতা। প্রেমাংশুর আখাম্বা চেহারা, জাঁদরেল ধড়াচূড়া আর রক্তচক্ষু দেখেই বোধ হয় সিঁটিয়ে রয়েছে।
বয়স বড়জোর পনেরো কি ষোলো। পানের মতো মুখের গড়ন। কিন্তু বেশ গোলগাল। ফরসা। মুখশ্রী মার্জিত। চোখ দুটি কাজল ছাড়াই কালো এবং বুদ্ধি উজ্জ্বল। শ্যাম্পু করা চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা। চুলের মধ্যে ঘাস লেগে রয়েছে। শাড়িতে রক্ত।
মেয়েটির শাড়ি ব্লাউজের মধ্যেও আধুনিকতার ছাপ। গোলাপি শাড়ি, গোলাপি ব্লাউজ। হাতা নেই। মসৃণ পেলব কাঁধে শুধু ফিতে। ঠোঁটে অরেঞ্জ লিপস্টিক।
ছেলেটির বয়স কুড়ির নীচে। গোঁফ-দাড়ি কামানো। ফরসা। চোখ দুটি বড় বড় এবং প্রাণবন্ত। সরু ধারালো নাক। দীর্ঘ কেশের অগ্রভাগ ঘাড়ের ওপর ঈষৎ বক্র। গালে আর ঘাড়ে শুকনো রক্ত।
পরনে গাঢ় নীল রঙের বুশসার্ট এবং স্টিল-গ্রে ট্রাউজার্স। স্মার্ট ফিগার। ঋজুদেহে সটান চেয়েছিল প্রেমাংশুর পানে। চাহনির মধ্যে বিদ্রোহ।
কোঁচার খুঁট-টা মুগার পাঞ্জাবির পকেটে সযত্নে রেখে পরিষ্কার বাংলায় বললে ইন্দ্রনাথ বৎস প্রেম, রোষ সম্বরণ কর। ভস্ম হয়ে যেতে পারে।
যুগল মূর্তি চমকে উঠল। কবিতার পরনে লালপেড়ে শাড়ি, কপালে লাল টিপ আর সীমান্তে সিঁদুর দেখে অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটে উঠল মেয়েটির চোখে।
গলা খাঁকারি দিয়ে বললে প্রেমাংশু–বাংলা রসিকতাও এরা বোঝে। কারণ এরা বাঙালি।
তাই নাকি? পর্যায়ক্রমে যুগল-মূর্তির ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ। নাম কী?
ঋতেশ রায়, বনলক্ষ্মী বক্সী, জবাব দিল প্রেমাংশু।
নমস্কার বিনিময় করার পর আমরা সকলেই বসে পড়লাম।
প্রেমাংশু বললে–এরাই লাশ আবিষ্কার করেছে।
সকৌতুকে বন্ধুবরের ভাটা-চক্ষুর পানে তাকিয়ে ইন্দ্রনাথ বলল-সেটা কি খুব অপরাধ?
সমস্ত ঘটনাটা শুনলে বুঝবি কেন রেগে আছি। বলল প্রেমাংশু। ঋতেশ রায় কলকাতার ছেলে। জুনিয়র টেনিস চ্যাম্পিয়ন। বেঙ্গল টিমের সঙ্গে এসেছে ব্যাঙ্গালোর টিমের সঙ্গে খেলবে বলে। উঠেছে ব্যাঙ্গালোর ক্লাবে। কালকে ওদের খেলা।
বনলক্ষ্মী বক্সী এখানকার মেয়ে। রিচার্ড টাউনে থাকে। মহারানী কলেজে পড়ে। ঋতেশ রায় ওর পত্ৰবন্ধু। তাই ওকে নিয়ে বেরিয়েছিল শহর দেখাতে।
মার্করার দিকে যে রাস্তাটা গেছে, ব্যাঙ্গালোর ক্লাব সেই দিকেই। ওই পথেই চন্দন খেতও আছে কয়েকটা। চন্দনগাছ আকারে ছোট। তাই ঝুপসি অঞ্চল চন্দন খেতে থাকে না। কিন্তু চামুণ্ডা এস্টেটের খেতে চন্দন ছাড়াও অন্যান্য গাছও আছে। জায়গাটা বড় রাস্তা থেকে দূরে। ঝোপে ঘেরা।
এইখানে একটা চন্দন গাছের গায়ে একটা লাশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে বনলক্ষ্মী আর ঋতেশ। গাছের দুটো শাখার জয়েন্টে চিবুক আটকে দুহাত দু-পাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটা উলঙ্গ দেহ। বছর চোদ্দ পনেরো বয়স। সারা গায়ে ছুরির কোপ। ফালাফালা করে চেরা। জ্যাক দি রিপারের আধুনিক সংস্করণ।