- বইয়ের নামঃ আলস্যের জয়গান
- লেখকের নামঃ বার্ট্রান্ড রাসেল
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, দর্শন, প্রবন্ধ
আলস্যের জয়গান
০১. আলস্যের জয়গান
আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল
মুখবন্ধ
রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে অনেক সামাজিক প্রশ্ন অনুকম্পায়ী বিবেচনার সুযোগ পায় না; উপেক্ষিত থেকে যায়। বর্তমান পুস্তকের নিবন্ধগুলোর বিষয় উপেক্ষিত সামাজিক প্রশ্নসমূহ। এখানে চিন্তারাজ্যে অতি-সংগঠনের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে অতিরিক্ত কর্মোদ্যোগের বিপদ সম্পর্কে। এখানে আমি ব্যাখ্যা করে বলেছি কেন আমার পক্ষে কী সাম্যবাদ কী ফ্যাসিবাদ কোনোটার পথ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এই মতবাদ দুটি যে সব ক্ষেত্রে অভিন্ন অভিমত পোষণ করে সে সব ক্ষেত্রেই আমি ভিন্ন মত পোষণ করতে বাধিত বোধ করি। বর্তমান পুস্তকে আমি এ কথাও বলতে চেয়েছি যে, জ্ঞানের গুরুত্ব তার ব্যবহারিক উপযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; জ্ঞান চিন্তা করার অভ্যাস প্রসারেও সহায়তা করে। এই কারণে আজকাল যে সব জ্ঞানকে অকেজো বলে চিহ্নিত করা হয় সে সব জ্ঞানের মধ্যে অধিকতর উপযোগিতা খুঁজে নিতে পারি। একটা নিবন্ধে স্থাপত্যকর্মের সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক প্রশ্নের সংযোগ বিষয়ে আলোচনা করেছি। বিশেষ জোর দিয়েছি অল্প বয়েসীদের কল্যাণ এবং নারীর মর্যাদা বিষয়ে।
রাজনীতি ক্ষেত্র থেকে সরে এসে, প্রতীচ্য সভ্যতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিষয়ে আলোচনা এবং কীট-পতঙ্গের অত্যাচারে মানব-বংশের বিলুপ্তির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে, সবশেষে আত্মার প্রকৃতি নির্ণয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই পুস্তকের নিবন্ধগুলো একটি সাধারণ সূত্র দ্বারা গ্রথিত, তা হলো: এই জগৎ অসহিষ্ণুতা এবং সংকীর্ণতার কারণে দুর্ভোগপীড়িত। তাছাড়া এই বিশ্বাসের জন্যও দুর্ভোগ পোহাচ্ছে: দিকনিশানাহীন কর্মোদ্যোগও প্রশংসার যোগ্য। অথচ আমাদের জটিল আধুনিক সমাজে সবার আগে দরকার সকল বিষয়ে ধীর-স্থির বিবেচনা, সকল মতবাদ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য সদা প্রস্তুতি। উপরন্তু মন শৃঙ্খলমুক্ত থাকবে, যাতে প্রচলিত নানা দৃষ্টিকোণ ন্যায্য বিচার পেতে পারে।
গ্রন্থের অন্যান্য নিবন্ধ বিষয়ে বলা যায়, কতকগুলো নতুন, কতকগুলো বিভিন্ন সাময়িকীতে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান গ্রন্থে লেখাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হলো উক্ত সাময়িকীগুলোর সম্পাদকদের অনুমতিক্রমে। আলস্যের জয়গান এবং আধুনিক মাইড্যাস প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল হার্পার্স ম্যাগাজিনে; ফ্যাসিবাদের পূর্বসূত্র (ভিন্ন নামে) ছাপা হয়েছিল ইংল্যান্ডের দ্য পলিটিক্যাল কোয়ার্টারলি এবং আমেরিকার দ্য আটলান্টিক মান্থলি সাময়িকীতে; সিলা ও কারিবডিস, অথবা সাম্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদ প্রকাশিত হয় দ্য মডার্ণ মান্থলিতে; আধুনিক সমরূপতা প্রথম স্থান পায় নিউ ইয়র্কের দ্য আউটলুক (বর্তমানে দ্য নিউ আউটলুক) সাময়িকীতে; শিক্ষা ও শৃঙ্খলা প্রকাশিত হয় দ্য নিউ স্টেটসম্যান এবং ন্যাশন সাময়িকীতে। এছাড়া পুস্তকের নানা নিবন্ধের নানা বিষয় নিয়ে পিটার স্পেন্সের সঙ্গে আলোচনা করে অনেক সহায়তা পেয়েছি।
—-বাট্রান্ড রাসেল
.
অধ্যায় ১ — আলস্যের জয়গান
আমার প্রজন্মের অন্য অনেকের মতো আমিও এই নীতিবাক্যের আবহে লালিত হয়েছিঃ শয়তান এখনো দুষ্কর্ম সাধনের জন্য অলস হাত খুঁজে পায়। অত্যন্ত সুবোধ বালক ছিলাম বলে সেকালে যা-কিছু শুনেছি তাই বিশ্বাস করেছি এবং এমনই বিবেকবান ছিলাম যে আজ পর্যন্ত কঠোর শ্রম দিয়ে যাচ্ছি। তবে আমার বিবেক আমার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করলেও ইতোমধ্যে আমার মতামতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। আমি মনে করি জগতে খুব বেশি কাজ করা হয়েছে। এবং কর্ম মাত্রেই পুণ্যময় এই বিশ্বাসের দরুন সাধিত হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। বস্তুত আধুনিক শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যা প্রচার করা দরকার ছিল তা এতকাল প্রচার করা হয়নি। একটা গল্পের উল্লেখ করছি, গল্পটা আপনারা সকলেই জানেন। জনৈক ভ্রমণকারী নেপলসে বারো জন ভিক্ষুককে রোদে শুয়ে থাকতে দেখেন (মুসোলিনীর শাসনকালের আগের গল্প), এবং যে সবচেয়ে অলস তাকে এক লিরা প্রদানে ইচ্ছুক হন। সেই বারো জন ভিক্ষুকের মধ্যে এগারো জন তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে ওঠে ভিক্ষা গ্রহণের জন্য। অতএব উক্ত ভ্রমণকারী দ্বাদশ ব্যক্তিটিকেই এক লিরা প্রদান করেন। তিনি ঠিক কাজটিই করেছিলেন। কিন্তু যে সব দেশের লোক ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের রোদে আলস্য উপভোগ করে না তাদের ব্যাপারটা বোঝানো একটু কঠিন কাজ বটে, তবে ব্যাপক গণপ্রচার দ্বারা এদের অলসদের কাতারে সামিল করা যায়। আমি আশা করছি এই নিবন্ধের পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো পাঠ করে তরুণদের খ্রিস্টীয় সংঘ প্রচার শুরু করে দেবেন যাতে ভালো ছেলেরা অতঃপর কিছু না করতে বা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে উদ্বুদ্ধ হয়। এবং যদি তাই ঘটে তাহলে আমার জীবন একেবারে বৃথা গেছে বলে মনে করবো না।
অলসতার পক্ষে যুক্তিসমূহ উপস্থাপনের আগে আমি অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য একটি যুক্তি বর্জন করবো। একজন ব্যক্তির কথা ভাবুন যার বাঁচার মতো যথেষ্ট সঙ্গতি আছে, তবু তিনি নিত্যনৈমিত্তিক কিছু কাজ করতে চান, যেমন স্কুলে ছাত্র পড়ানো কিংবা মুদ্রাক্ষরিকের কাজ। তাঁর সম্পর্কে বলা হলো যে তিনি অন্যের মুখের ভাত কেড়ে নিচ্ছেন, অতএব তিনি দুষ্ট প্রকৃতির। এই যুক্তি যদি বৈধ হতো তাহলে আমাদের সবার অলস হওয়ার দরকার ছিল শুধু এ জন্য যে আমাদের কেবল প্রয়োজনীয় খাবার থাকলেই যথেষ্ট। যারা এ ধরনের কথা বলেন তারা ভুলে যান যে, একজন ব্যক্তি যা আয় করেন তিনি তা ব্যয় করেন। এবং এই ব্যয়ের মাধ্যমে অপরকে কাজের সুযোগ দেন। যতক্ষণ একজন মানুষ তার আয় ব্যয় করেন, তিনি তার ব্যয় দ্বারা অপরের জন্য যতটুকু আহার্য যোগান, আয় দ্বারা ততটুকুই অপরের মুখের ভাত কেড়ে নেন। তাহলে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হলেন তিনি যিনি সঞ্চয় করেন। প্রবাদের ফরাসি কৃষকের মতো তিনি যদি শুধু সঞ্চয়ের জন্য সঞ্চয় করেন তাহলে এতে কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ হয় না। তিনি যদি তার সঞ্চয় বিনিয়োগ করেন তাহলে ঘটনা ভিন্ন রূপ ধারণ করে।