- বইয়ের নামঃ টারজান রচনা সমগ্র
- লেখকের নামঃ এডগার রাইস বারোজ
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, ভূতের গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রচনাবলী
টারজান রচনা সমগ্র
অজেয় টারজন (টারজান দি ইনভিন্সিবল)
যে গল্পটা আমি বলতে যাচ্ছি সেটা যদি দুটি নির্দিষ্ট ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত তাহলে তার ফলে মহাযুদ্ধের চাইতেও ভয়ঙ্কর আর একটা যুদ্ধ বেধে যেতে পারত। কিন্তু তা নিয়ে আমার কোন রকম মাথা ব্যথা নেই। আমার কথা হচ্ছে, গল্পটা খুব ভাল আর এই কাহিনীর অনেকগুলো লোমহর্ষক অধ্যায়ের সঙ্গে অরণ্যরাজ টারজান খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
আফ্রিকার জঙ্গলে পাকাঁপোক্তভাবে গড়া একটা ছোটখাট শিবির। অনেক কালো মানুষ গোমাঙ্গানি অর্থাৎ নিগ্রো আর কিছু সাদা মানুষ অর্থাৎ টারমাঙ্গানি সেখানে বাস করে। তারা বেশ কিছুদিন এখানে আছে। মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন থাকবে। সাধা মানুষদের জন্য চারটে তাবু আর আরবদের জন্য ‘ব্যেট’গুলো বেশ সুন্দরভাবে শৃঙ্খলার সঙ্গে সাজানো; তার পিছনে আছে স্থানীয় গাছ-গাছালি দিয়ে তৈরি নিগ্রোদের চালাঘর।
একটা ‘ব্যেট’ এর সামনে খোলা জায়গায় বসে জনাকয় বেদুইন তাদের প্রিয় কফি খাচ্ছে; আর একটা তাবুর সামনে গাছের ছায়ায় বসে চারজন সাদা মানুষ তাস খেলছে; চালাঘরে একদল দীর্ঘদেহী গালা যোদ্ধা মিংকালা’ খেলছে; অন্য জাতির কালা মানুষরাও সেখানে আছে পূর্ব আফ্রিকার ও মধ্য আফ্রিকার মানুষদের সঙ্গে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কিছু পূর্ব উপকূলের নিগ্রো অধিবাসী। তাদের সঙ্গে এত বেশি রাইফেল আছে যে মনে হয় বুঝি তাদের প্রত্যেকের জন্যই একটা করে রাইফেল আছে।
একটা পাগড়ি-বাঁধা কালো পূর্ব-ভারতীয় মানুষ তাঁবুর সামনে পা ভেঙে বসেছিল। তার চোখে রয়েছে কিছু দূরের আর একটা তাঁবুর দিকে। একটু পরেই একটা মেয়ে যখন সেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল, তখনই রঘুনাথ জাফল উঠে তার দিকে এগিয়ে গেল। মিষ্টি হেসে তাকে কি যেন বলল। মেয়েটি উত্তর দিল, কিন্তু হাসল না। তারপরই যারা তাস খেলছিল মেয়েটি তাদের দিকে এগিয়ে গেল।
একটি পরিষ্কার মুখ বড়সড় লোক বলে উঠল, হেলো জোরা! ভাল ঘুম হয়েছে তো?
মেয়েটি বলল, তাতো হয়েছে কমরেড; কিন্তু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে বিরক্তি ধরে গেল। এভাবে অকর্মার মত তো আর বসে থাকা যায় না।
যা বলেছ। আমরাও সেই দশা।
রঘুনাথ জাফর শুধাল, কমান্ডার জাভেরি মার্কিনী লোকটির জন্য তুমি আর কতদিন অপেক্ষা করবে?
বড় কর্তাটি কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তাকে আমার দরকার। বংশজাত ধনী মার্কিনীটিকে আমাদের কাজের জন্য সক্রিয়ভাবে যুক্ত রাখার নৈতিক সুবিধার কথা চিন্তা করেই তার জন্য অপেক্ষা করাটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছি।
মেক্সিকোবাসী কৃষ্ণকায় যুবক রোমেরো বলল, এই লোকগুলো সম্পর্কে আমি কিন্তু সর্বদাই সন্দিহান। পুঁজিবাদই তাদের একমাত্র ভরসা। মনে-প্রাণে তারা সর্বহারাদের ঘৃণা করে, ঠিক যেমন আমরা তাদের ঘৃণা করি।
জাভেরি তবু বলল, এ লোকটি একটু স্বতন্ত্র মিগুয়েল। সে পুরোপুরিভাবেই আমাদের দলে এসে গেছে।
যে লোকটি এখনও জমায়েতে হাজির হয়নি তার সম্পর্কে এইসব কথা শুনে জোরা ড্রিনের ঠোঁট ঈষৎ ঘৃণায় বেঁকে গেল।
বেলা গড়িয়ে এল।
আর একটা দলের আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে একটি যুবক মাথাটা খাড়া করে কান পাতল। বলল, এত দূরে তো নয় টনি।
না স্যার, আরও অনেক কাছে, ফিলিপিনোটি উত্তর দিল।
যুবকটি বকুনির সুরে বলল, অন্য সকলের সঙ্গে দেখা হবার আগেই ওই ‘স্যার কথাটা তোমাকে ছাটাই করতে হবে টনি।
ফিলিপিনোটি মুচকি হেসে বলল, ঠিক আছে কমরেড। সকলকেই আমি স্যার’ বলি তো, তাই ওটা পাল্টানো একটু শক্ত।
তাহলে তো তুমি খুব সাচ্চা লাল হতে পারনি টনি।
ফিলিপিনোটি এবার জোর গলায় বলল, আমি নিশ্চয় সাচ্চা লাল। না হলে এখানে এসেছি কেন? তুমি কি মনে কর সিংহ, পিঁপড়ে, সাপ, মাছি ও মশায় ভর্তি এই নিষিদ্ধ দেশে আমি বেড়াতে এসেছি? না, আমি এসেছি ফিলিপিনের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে।
অপরজন গম্ভীর গলায় বলল, কিন্তু তুমি এখানে আসায় ফিলিপিনের মানুষ স্বাধীন হবে কেমন করে?
এন্টনিও মোরি মাথা চুলকে বলল, তা জানি না; তবে এর ফলে আমেরিকার বিপদ হবে।
নতুন দিন দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে শিবিরবাসীদের মধ্যেও দেখা দিল নতুন কর্মব্যস্ততা। একটা ফোল্ডিং ক্যাম্প-টেবিলে বসে জাভেরি সহকারীদের নির্দেশ দিচ্ছে; জোরা ও রঘুনাথ জাফরের সাহায্যে সারিবদ্ধ সশস্ত্র মানুষগুলোর হাতে গুলি-গোলা তুলে দিচ্ছে। শেখ আবু বতন তার রোদে-পোড়া সৈনিকদের নিয়ে দূরে বসে আছে।
জোরা বলল, শিবির পাহারা দেবার জন্য কতজনকে রেখে যাচ্ছ।
জাভেরি জবাব দিল, তুমি ও কমরেড জাফর এখানেই থেকে যাবে। শিবিরের রক্ষী হিসেবে তোমরা ছেলেরা থাকবে; তাছাড়া দশজন আস্কারিও এখানে থেকে যাবে।
মেয়েটি বলল, তাই যথেষ্ট। এখানে কোন বিপদ নেই।
জাভেরি বলল, না। এখন নেই, তবে সেই টারজান এসে পড়লে ব্যাপারটা অন্য রকম দাঁড়াবে। তবে আমি শুনেছি সে নাকি অনেক দিন এ দেশে নেই। আকাশ পথে কি একটা অভিযানে বেরিয়েছে। সেই। থেকে তার কোন খবর নেই। প্রায় নিশ্চিত যে সে মারাই গেছে।
শেষ কালো মানুষটির হাতে গুলি-গোলা পৌঁছে দেয়া হয়ে গেলে কিটেম্বো তার স্বজাতীয়দের কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় কি যেন বোঝাতে লাগল। তারা সকলেই বাসোম্বা; তাই তাদের সর্দার কিটেম্বো তাদের ভাষাতেই কথা বলছে।