- বইয়ের নামঃ ধ্বংস পাহাড়
- লেখকের নামঃ কাজী আনোয়ার হোসেন
- সিরিজঃ মাসুদ রানা
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অপরাধ, রোমাঞ্চকর গল্প, কল্পকাহিনী, অ্যাডভেঞ্চার, গুপ্তচর, অ্যাকশন
ধ্বংস পাহাড়
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
প্রথমেই বলে রাখি, এই বই বড়দের জন্যে লেখা।
বাংলা সাহিত্যে রহস্যোপন্যাস বলতে বোঝায় কেবল ছোট ছেলে মেয়েদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা এক ধরনের উদ্ভট গল্পের বই, যা হাতে দেখলে বাবা, কাকা, ভাইয়া এবং মাস্টার মশাই প্রবল তর্জন গর্জন করে কেড়ে নিয়ে নিজেরাই পড়তে লেগে যান, গোপনে।
কেন পড়েন?
কারণ এর মধ্যে এমন এক বিশেষ রস আছে যা প্রচলিত অর্থে যাকে আমরা সুসাহিত্য বলি তার মধ্যে সাধারণত পাওয়া যায় না। তাই ছোটদের বই থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে, আংশিক হলেও, আনন্দ লাভ করেন বড়রা।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিশেষ করে ছোটদের জন্যে লেখা বলে এসব বইয়ে ছেলেমানুষির এতই ছড়াছড়ি থাকে যে আমরা বড়রা এই বই পড়ি, এবং এ থেকে আনন্দ পাই তা স্বীকার করতে লজ্জা বোধ করি।
তাই ছেলেমিটাকে যতদূর সম্ভব এড়িয়ে গিয়ে বড়দের উপভোগ্য রোমাঞ্চকর রহস্যোপন্যাস রচনা করবার চেষ্টা করলাম।
এ চিন্তা মাথায় ঢুকিয়েছেন বন্ধুবর মাহবুবুল আমীন (আবু)। তারই উৎসাহে এবং সর্বপ্রকার সহযোগিতায়, বলতে গেলে এক রকম বাধ্য হয়েই, লিখতে হলো ধ্বংস-পাহাড়। তাই এর নিন্দার সবটুকু গ্লানি অম্লান বদনে মাথা পেতে নিতে তিনি বাধ্য।
প্রশংসার কথা কিছু বললাম না। যদি কিছু জোটেই, ভাবছি একা নিজেই চুপচাপ হজম করে ফেলব কিনা।
কাজী আনোয়ার হোসেন
মে, ১৯৬৬
.
১
কাপ্তাইয়ে কার্যরত আইইকো, অর্থাৎ স্যানফ্রান্সিসকোর ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার আর.টি. লারসেন তাঁর সুদৃশ্য বাংলোর সামনে। লনে বসে কফির কাপটা মুখে তুলতে গিয়ে স্তব্ধ বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন সামনে দাঁড়ানো লোকটার মুখের দিকে। ভুরু জোড়া কুঁচকে গেছে তার। একটা আঙুল দিয়ে বর্মা চুরুটের পুরু ছাই ঝাড়লেন। তারপর ভাঙা উর্দুতে বললেন, বল কী, আবদুল! এ কি সম্ভব?
ফ্রন্টিয়ারের আবদুর রহমান উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, হামি নিজে তিন দিন দেখছি, স্যর। কেউ হামার কোথা বিশওয়াস করে না, হাঁসি উড়ায়। শেষতক আপনার কাছে আসছি, হাজুর। হামি কসম খেয়ে…’
‘আমাকে দেখাতে পারো? ওকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মি. লারসেন।
‘আলবাত! আর আধঘণ্টা পরেই আসবো তারা। ওই স্পীড বোট হামাদের, ফিশারীরও না। আজই দেখাতে পারি আপনাকে, হাজুর।’
‘বেশ, আমি তোমাকে হেসে উড়িয়ে দেব না। তুমি যাও, আমি ঠিক সাতটার সময় ড্যামের ওপর আসছি।’
খুশি মনে সাহেবের বাংলো থেকে বেরিয়ে এল আবদুর রহমান। একবার ভাবল, আজ যদি ওরা না আসে? বোকা বনতে হবে সাহেবের কাছে।যাক, দেখা যাক কী হয়।
আজ আট বছর ধরে সে কাজ করছে প্রজেক্টের সারভে ডিপার্টমেন্টের নিম্নতম পদে। কাপ্তাইকে সে ভালবেসে ফেলেছে সমস্ত হৃদয় দিয়ে। ওর চোখের সামনেই তিল তিল করে বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়েছে এই বাঁধ। প্রজেক্টের খুঁটিনাটি ওর নখদর্পণে। ড্যামের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের দিকে লক্ষ রাখার গুরু দায়িত্ব ওর ধারণা ওরই উপর ন্যস্ত আছে। সীমান্ত প্রদেশের আবদুর রহমান এখানে এসে সবার প্রিয় আবদুল হয়ে গেছে। সাহেব সুবোরা স্পীড বোটে করে বেড়াবেন, কি পাহাড়ি গ্রাম দেখতে যাবেন, কিংবা ষাট মাইল উত্তরে যাবেন হরিণ শিকারে, সঙ্গে যাবে কে-ওই আবদুল। সবকিছুতেই ওর অক্লান্ত উৎসাহ। এই পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথায় যায়নি সে? চল্লিশ মাইল পায়ে হেঁটে দুর্গম লুসাই হিলেও গেছে সে। সাহেবদের সঙ্গে।
কদিন ধরে একটা ব্যাপার লক্ষ করে বড় উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে আবদুল ভিতর ভিতর। আর দুইদিন পর প্রেসিডেন্ট আসছেন প্রজেক্ট ওপেন করতে। ছোট্ট, শহরটায় তাই অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। প্রচুর আইবি, সিআইডি ঘুরঘুর করছে শহরের আনাচেকানাচে। কিন্তু আইবি কর্মতৎপরতা বলে এই ঘটনাকে হাল্কা করে দেখতে পারেনি সে। তাই যদি হয় তা হলে ভুড়ভুড়ি কীসের?
এক টিপ খইনি নীচের ঠোঁট আর দাঁতের ফাঁকে যত্নের সঙ্গে ছেড়ে দিয়ে সেটাকে জিভ দিয়ে ঠিক জায়গামত বসিয়ে নিল আবদুল। তারপর স্পিলওয়ের গার্ডরুমে ঢুকে দোনলা বন্দুকধারী দেশোয়ালী ভাইয়ের সঙ্গে অনর্গল পশতু ভাষায় কিছুক্ষণ ভাব আদান-প্রদান করল।
ঠিক সাতটায় দূর থেকে লারসেন সাহেবকে আসতে দেখে এগিয়ে গেল আবদুল। সন্ধ্যার আর দেরি নেই।
কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর রিজারভয়েরের মধ্যে দূরে একটা স্পীড-বোট দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন মি, লারসেন। উঁচু একটা টিলার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা। আরও আধ ঘণ্টা পর আবদুলের কথামত সত্যিই পানির উপরে ছোট ছোট বুদ্বুদ দেখা গেল। শক্তিশালী টর্চ জ্বেলে দেখা গেল সেই টিলার দিক থেকে বুদ্বুদের একটা রেখা ক্রমেই এগিয়ে আসছে বাঁধের দিকে। গজ পনেরো থাকতে এগোনোটা থেমে গেল-এবার এক জায়গাতেই উঠতে থাকল বুদ্বুদ। . মি. লারসেন উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘মাইগড়! আশ্চর্য! আবদুল, তুমি ছুটে যাও তো, স্টোর থেকে আমার নাম করে দুটো অ্যাকুয়ালাঙ (ডুবুরির পোশাক) নিয়ে এসো এক্ষুণি। আর যাওয়ার পথে লোকমানকে বলে যাও আমাদের স্পীড বোট রেডি করে ঘর থেকে যেন আমার রাইফেলটা নিয়ে আসে। যাও, কুইক।’