পরী – আলাউদ্দিন আল আজাদ
একেবারে পিছনে ঘনঘোর রাক ঝাড়ের কাছাকাছি ছনের তৈরি মোল্লাবাড়ির রান্নাঘর। একটু বাতাস বইলে চালের ওপর যে ন্সর আওয়াজ হয়, তা যেন বাঁশপাতার নয়, ভূতপ্রেতের ফিসফিসানি, কানাকানি; নিশুতি রাত্রে সেই একটানা করুণ সুর শুনলে দেহের রক্ত ঠাণ্ডা হিম হয়ে যেত কতক্ষণ। বেড়াগুলোও প্রজার, বেশি মজবুত নয়, ঘরে ঢোকবার জন্য খুব কায়দা করার প্রয়োজন নেই, ভোতা একটা দা দিয়ে কয়েক মিনিট কোপালেই যথেষ্ট। উপরন্তু, বড়ঘর থেকে অন্তত দশহাত দূরে, যদিও দুই ঘরের মধ্যে যাতায়াতের সুবিধের জন্য বারান্দার ওপর দিয়ে আছে কেরোসিন-টিনের চাল, এসব কারণে এখানে কোনো অঘটন ঘটলে বাড়ির ভেতরের লোকের চট করে জানবার কথা নয়।
কিন্তু জীবনে এমন মুহূর্তও তো আসে যখন দুনিয়ার সমস্ত রকম ভয়-র নেহাত তুচ্ছ মনে হয়?
আজ পরীর অবস্থাও তাই, নইলে সোয়ামির ঘর থাকতে এমন অন্ধকার রাত্রে এই রান্নাঘরে এসে শোবে কেন?
সারাদিন মোন্নাবাড়ির হাঁড়ি ঠেলবার পর এক থালা ভাত রকারি নিয়ে গিয়েও রেহাই পায়নি। পেট ভরে খেয়ে উঠেও কিনা লোকটা গায়ে হাত তুলল। তাও যে সে মার নয়! কিল চাপড় দেখা যায় না, কিন্তু রোজ রোজ কাঁচা শরীরে কত সয়? শেষমেষ যে একটা লাথি মেরেছিল তা কোঁকে লাগলে দম বন্ধ হয়ে মরেই যেত হয়তে। বিয়ের সময় দুই কুড়ি পাঁচ টাকা খরচ করেছিল বলে এমনভাবে মেরে ফেলবার অধিকার তার নেই! নসিব, সব নসিব! নইলে এমন জামাইয়ের হাতে পড়বে কেন রী। চোরের চেয়ে চাষাভুষা অনেক ভালো। বয়েস আছে, এখন তালাক দিয়ে দিলেই সে বাঁচে; কিন্তু মাঝে মাঝে মিষ্টি মিষ্টি রঙ্গরসের কথাও যে বলে। চুরিধারি করে হলেও শাড়িটা-চুড়িটা এনে দেয়। সেদিন এনেছে সুবাসী তেল, আর এক ডিবে সোননা। বোঝা যায়, মিনসে সহজে ছাড়বে না। যদি না ছাড়ে, সে পালিয়ে যাবে শহরে বন্দরে কোথাও।
তবু, দোষ পেয়ে মারলে তা সওয়া যেত; কিন্তু এ যে অকারণ অত্যাচার। নিজে চুরি করে বলে তাকেও চুরি করতে বললে নারাজ হবে না?
এতবড় মোগ্লাবাড়িতে কোথায় কোন্ জিনিসটা থাকে তার স্বই জানে পরী এবং ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই সরাতে পারে। কিন্তু তাই বলে কি সে ঘরে আগুন দেবে? এ কাজ সে করবে কিসের জন্য? জানে খেটে খেয়ে না খেয়ে এমনিতেই দিন কেটে যাচ্ছে। জানে মতিগতি সুবিধে নয়, সারাদিন পড়ে ঘুমোয় আর রাত্রে বেরিয়ে পড়ে। এও না হয় সহ্য করা গেল, কিন্তু তার অন্য নজরও আছে: প্রথম বৌকে ছেড়ে ওকে বিয়ে করেছে, এবং গোটা চল্লিশেক টাকা জমাতে পারলে আরেকটা বিয়ে করতে পিছপা হবে না। আর সতীনের ঘর করার চেয়ে পরের বাড়িতে বাদি হয়ে থাকায় বরং বেশি সুখ।
কুঃ! কুঃ! ঘরের চালের কাছে বাঁশঝাড়ে পাচা ডাকছে পরী এতক্ষণ শুনতে পায়নি, হঠাৎ খেয়াল করলে বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে। প্যাচার এই একটানা বীভৎস ডাক নাকি মৃত্যুর সংকেত। কা’র মরণ ঘনিয়ে এসেছে।
বাঁশের ঝাঁপটা টেনে দেওয়া ছিল, সেটা একসময় মম শব্দে ফাঁক হয়ে গেল। প্রথমে একটা কালো হাত, তারপর গোটা কালো লোকটাই দরজার কাছে দাঁড়াল। খানিকক্ষণ কি ভেবে নিয়ে ঝাঁপটা আরেকটু ঠেলে ভেতরে চলে আসে। পরীক্ষা এতক্ষণ দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি, কিন্তু জেগে থাকলে কি হবে হঠাৎ যেন তাকে বোবায় পেয়েছে। চিৎকার করার বদলে সে ভয়ে জমে গেল।
কাঁথার ধারে বসে গায়ে হাত দিলে বুঝতে বাকি রইল না কিছু। কিন্তু বুড়ো লোকটাও এরাত জেগে থাকতে পারলো? ঘুমের ভান করে পরী নিপ পড়ে থাকে।
.
প্রথম যেদিন এবাড়িতে কাজ করতে আসে সেদিনই দুপুরে ধনু মোল্লার মেজাজ দেখে অনেকে অবাক হয়েছিল। নাম নিলে হাঁড়ি ফাটে এমন কিপটে। বাপের কিছুই ছিল না, কেবল এই গুণটি থাকাতে এখন সেরা গেরস্ত, গ্রামের প্রধান। যুবা বয়েসেও নেংটি মত গামছা পরে থেকেছে, সে অভ্যেস ভুলতে পারেনি বলেই হয়তো এখনো একটা কম-উসারী লুঙিই শীত-গ্রীষ্মের সম্বল। মার্কিন কাপড়ের একটা ফতুয়া আছে বাজারে গেলে আর জুম্মার দিনে সেটা পরে। এমন লোক, নিজেরা যাই খাক, মুনি মজুরদের জন্য শেওড়া গোটার মতো মোটা চালের ভাত আর লম্বা ডালের ব্যবস্থা করলে তাতে আর বিচিত্র কি? কিন্তু সেদিন রীকে ভাজা রুইমা টুকরো না দেওয়াতে বউঝিদের অনেকক্ষণ গালাগাল করেছিল।
মেজো বলল, আমার নতুন মা অইব পরী, হের লাইগা বাজানের অমুন গোব্য। ননদের কথা শুনে বৌরা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। বড় বৌ বলল, মেসাহেব একটা নিহা করাইলে ভালোই অয়।
মোল্লাকে কেন পরী নানা ডাকল সে নিজেই জানে না, হয়তো থুৎনিতে পাকা দাড়ি আর মাথায় গোলটুপি দেখে এর বেশি ভাবতে পারেনি। নানা ডেকেছে বলেই ওদের কথাগুলো কাছে থেকেই হজম করল। নইলে ফড়িং-এর মতো মেয়েটি হলে কি হবে, ও কম মুখরা নয়, বৌদের বেশ কড়া কথা শুনিয়ে দিত।
দুতিনটা নাতিনাতনি নিয়ে বড় ঘরে থাকে মোল্লা। পঞ্চাশ সালের রায়টের সময় বুড়ি এন্তেকাল করেছেন। ছেলেরা উপযুক্ত, বেশ জোয়ান জোয়ান, এবং তারাই চাষবাস থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় ব্যাপার দেখতে পারে। কিন্তু বাপকে মানিয়ে রাখতে পারে না এখনো সারাদিন কাজ করে ঠিক আগের মতে বাড়ির সকলে যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন উঠে একটা হাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মাঠের উদ্দেশ্যে। নয় যায় জমি দেখতে। ক্ষেত্রে কাজ না থাকলে বেতেরকাজ। তার হাতের তৈরি বুচুন বিখ্যাত; একেকটা দশটাকা পর্যন্ত বিক্রি যায় কিনা কথায়। জোরের কাজেও যে কজি শক্ত আছে সে একদিন বুঝেছিল তখন দেখে এবড় লোহার সিন্দুকের ডালাটা বাঁ হাতে কেমন অনায়াসে তুলে ফেলল। কলকের মধ্যে নিটে টিকে ধরিয়ে রেখে গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিতে দিয়ে গিয়েছিল পরী, কাছে থেকেই মোল্লা মুখ তুলে চাইল, চোখ শিকার করে বসল, দ্যাখ, পরী দেইখা যা।