- বইয়ের নামঃ মিশরের ইতিহাস
- লেখকের নামঃ আইজাক আসিমভ
- প্রকাশনাঃ সন্দেশ
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, ইতিহাস
মিশরের ইতিহাস
০১. প্ৰাগৈতিহাসিক মিশর
মিশরের ইতিহাস – আইজাক আসিমভ – অনুবাদ: দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মন
১. প্ৰাগৈতিহাসিক মিশর
নীল নদ
উত্তর আফ্রিকায় প্রবাহিত এক অস্বাভাবিক নদ। ৪১৫৭ মাইল দীর্ঘ- পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী- যার নাম নীল নদ। নামটি এসেছে গ্রিক শব্দ নীলোস থেকে। গ্রিকরা কোথা থেকে পেল শব্দটা তা অজানা, কারণ এর তীরে যারা বাস করত তারা এটাকে শুধু “নদী” বলেই জানত।
নীল নদের সবচেয়ে উত্তরে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন দুটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, আর প্রায় ছয় হাজার বছর ধরে এর উভয় কুল বরাবর গ্রামগুলিতে জটিল সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
এ সময়টাতে কেউই জানত না এই নদের উৎপত্তি কোথায় হয়েছে। এর জলধারা দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত। তবে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কোনো মানুষই সর্ব দক্ষিণে এর উৎসস্থল আবিষ্কার করতে পারেনি। প্রাচীন জাতিসমূহের কাছে নীলের উৎস সন্ধান ছিল চাঁদের অপরপৃষ্ঠ আবিষ্কারের মতোই কৌতূহলোদ্দীপক আর দুঃসাধ্য- যতদিন না উপগ্রহের মাধ্যমে চাঁদের উল্টোপিঠের ছবি আমাদের দৃষ্টিসীমায় আসে, ততদিন চাঁদের উল্টোপিঠের চেহারা ছিল সবার অজানা।
শুধু উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধেই ইউরোপীয় আর আমেরিকান অভিযাত্রীরা নীল নদের গতিপথ অনুসরণ করে তার উৎসমূলে পৌঁছতে সমর্থ হয়। ১৮৫৭ সালে জন হেনিং নামে এক ইংরেজ এক বিশাল হ্রদ ভিক্টোরিয়াতে পৌঁছে ব্রিটেনের তৎকালীন রানির নামানুসারে তার নাম রাখে ভিক্টোরিয়া। এটা ঠিক নিরক্ষরেখার উপর আর এখান থেকেই নীল নদের উৎপত্তি। মধ্য-পূর্ব আফ্রিকার ছোট বড় অনেক নদীই এসে মিশেছে নীল নদের সাথে।
উত্তরমুখী গতিপথে একে অনেক সংকীর্ণ আর খাড়া উপত্যকা পেরিয়ে যেতে হয়েছে। উন্মত্ত জলধারা প্রস্তরখণ্ডের উপর ছিটকে পড়ছে আর নিম্নমুখী গতিপথে সৃষ্টি করেছে অনেক জলপ্রপাত। উত্তাল জলধারা আর জলপ্রপাত পার হয়ে জাহাজ চলাচল সম্ভব নয়, আর তাই নদীটা বিভক্ত রয়েছে কয়েক খণ্ডে।
প্রপাতগুলির সংখ্যা নির্ণয় করা হয় উত্তর থেকে দক্ষিণে। প্রথম প্রপাতটা অবস্থিত মোহনা থেকে প্রায় ছয়শ মাইল দক্ষিণে। বর্তমানে প্রপাতটা আসোয়ান শহরের সামান্য দক্ষিণে, তবে প্রাচীনকালে গ্রিকদের কাছে শহরটা পরিচিত ছিল “সাইয়িনি” নামে।
মোহনা থেকে প্রথম প্রপাত পর্যন্ত নীল নদের প্রথমাংশ এই গ্রন্থের মূল দৃশ্যপট। নদীর এই অংশ অতি সাধারণ নৌযানের জন্যও সহজনাব্য, যার ফলে এখানেই গড়ে উঠেছে এক লক্ষণীয় সভ্যতা।
সাহারা মরুভূমির পূর্বপ্রান্ত ঘেঁষে নীল নদ প্রবাহিত। সাহারা (আরবী ভাষায় যার অর্থ মরুভূমি) উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ এলাকা জুড়েই অবস্থিত আর এর আয়তন প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের সমান। প্রকৃতপক্ষে এটা পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি। এই গোটা এলাকাতেই কোনো বৃষ্টিপাত নাই। যেটুকু পানি আছে তা মাটির অত্যন্ত গভীরে, শুধু মাঝে মাঝে মরুদ্যানে তা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি উঠে এসেছে।
তবে সাহারা চিরকাল মরু অঞ্চল ছিল না। বিশ হাজার বৎসর পূর্বে ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা হিমবাহে আবৃত ছিল, আর শীতল বায়ুপ্রবাহ সেখান থেকে আর্দ্রতা বয়ে নিয়ে আসত উত্তর আফ্রিকায়। আজ যেখানে মরুভূমি সেকালে সেখানে ছিল নদী, হ্রদ, অরণ্য আর তৃণভূমিশোভিত মনোরম এক ভুখও। প্রাগৈতিহাসিক মানুষরা সেখানে ঘুরে বেড়াত আর তারাই রেখে গেছে পাথরের অমসৃণ অস্ত্রশস্ত্র।
ধীরে ধীরে অপসৃত হলো হিমবাহ আর জলবায়ু হতে থাকে উষ্ণতর আর শুকতর। অধিক সংখ্যায় মানুষ নীল নদের আশেপাশে ভিড় জমাতে থাকে। শুরু হলো অনাবৃষ্টি আর ধীরে ধীরে তা তীব্রতর হয়ে উঠল। গাছপালা মরে গেল আর জীবজন্তু আর্দ্রতর অঞ্চলের দিকে সরে যেতে থাকে যেখানে তারা পর্যাপ্ত খাদ্য আর উপযুক্ত আবাসস্থল পাবে। মানুষও সরে যেতে থাকে কিছু দক্ষিণে বিষুবীয় অঞ্চলের দিকে আর কিছু উত্তরে সমুদ্র উপকূলের দিকে। সবচেয়ে বেশি জড়ো হতে থাকে নীল নদের উপত্যকায়, সেই সুদূর অতীতে যা ছিল আরও প্রশস্ততর আর ধীরগতিতে প্রবহমান ছিল বৃহৎ জলাভূমির মধ্য দিয়ে। বাস্তবিকপক্ষে নীল নদের উপত্যকা মানববসতির জন্য মোটেই সুখকর ছিল না যতদিন না এর জলধারা কিছুটা হ্রাস পায়।
এমনটা ঘটার পরে নীলের উপত্যকা হয়ে উঠল ঈশ্বরের আশীর্বাদরূপে। আবহাওয়া যতই শুষ্ক হোক না কেন নীল নদ হয়ে রইল মাটি ও মানুষের জন্য নিরন্তর পানির উৎস, যাতে করে জীবন যে শুধু সম্ভব তাই নয় আরামদায়কও হয়ে উঠল।
সমগ্র শীতকালব্যাপী মধ্য-পূর্ব আফ্রিকার পর্বত শীর্ষে ভূপীকৃত হতে থাকে বরফ। বসন্তের আগমনে বৃষ্টি নামে আর জমাট বরফ গলতে শুরু করে। বিপুল জলধারা পর্বতের গা বেয়ে প্রবল বেগে নেমে আসে আর তা নদীর স্রোতে আর বড় বড় হ্রদের জলে মিশে যায়। অবশেষে এই জলধারা এসে পড়ে নীল নদে আর তা উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়।
নীল নদে প্রবাহিত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে জুলাই মাস থেকে আর তা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে সেপ্টেম্বরে। পানির উচ্চতা স্বাভাবিক স্তরে নেমে আসে অক্টোবরে। ফিতকায় পানির প্রবাহ কূল ছাপিয়ে দু পাশের তৃষ্ণার্ত ভূমিকে সিক্ত করে আর উত্তরের পাহাড় থেকে বয়ে নিয়ে আসে উর্বর পলিমাটি। কাজেই নদী উপত্যকার মাটির অবিরাম রূপান্তর ঘটছে আর উর্বরতা বজায় রাখছে।