- বইয়ের নামঃ অস্কার ওয়াইল্ড গল্পসমগ্র
- লেখকের নামঃ অস্কার ওয়াইল্ড
- প্রকাশনাঃ পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই
অনুরক্ত বন্ধু
একদিন সকালে একটা বুড়ো ভলো ইঁদুর গর্ত থেকে তার মাথাটা বার করে দিল। তার ছোটো ছোটো চোখ দুটো চকচকে, শক্ত গোঁফ জোড়া ধূসর রঙের আর ন্যাজটা হচ্ছে কালো ভারতীয় রবারের মতো। ছোটো-ছোটো হাঁসগুলো সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছিল পুকুরে দেখতে তাদের হলদে ক্যানারি পাখির মতো। তাদের মার পা দুটো সত্যিকার লাল। কেমন করে জলে। মাথার ওপরে দাঁড়াতে হয় মা তাদের সেই শিক্ষাই দিচ্ছিল। সে তার বাচ্চাদের বারবার সাবধান করে দিচ্ছিল—’মাথার ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়াতে না শিখলে কোনো উঁচু সমাজে তোমরা কলকে পাবে না।’ কিন্তু বাচ্চারা সেকথা গ্রাহ্যই করছে না। বাচ্চা বলেই বোধ হয় সভ্য সমাজে ঢুকতে পারার সুবিধে কত তা তারা জানত না।
জলের ইঁদুর চিৎকার করে উঠল-বেয়াদপ ছোকরা সব বটে! ওদের ডুবে মরাই ভালো। মা-হাঁসটা বলল–মোটেই না। প্রত্যেককেই শেখার সুযোগ দিতে হয়। তাছাড়া, মাদের কোনো বিষযেই ধৈর্য হারালে চলে না।
জলের ইঁদুর বলল–তাই নাকি! তা, বাপ-মাযের অনুভূতির সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। সংসার বলতে কি নেই আমার। আসল কথাটা হচ্ছে, আমি কোনো দিন বিয়ে করিনি ভবিষ্যতে বিয়ে করার ইচ্ছেও আমার নেই। একদিক থেকে প্রেম জিনিসটা ভালোই; তবে অনুগত বন্ধুত্ব তার চেয়েও ভালো।
কাছাকাছি একটা উইলো গাছের ডালে একটা সবুজ রঙের লিনেট পাখি বসেছিল। ওদের আলোচনা শুনে সে বলল–তাই বুঝি! কিন্তু জিজ্ঞাসা করি অনুগত বন্ধুর দায়-দায়িত্ব কী?
মা-হাঁসটা বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ওই কথাটা আমিও জানতে চাই। এই বলে সে সাঁতার কাটতে কাটতে পুকুরের আর একপাশে গিয়ে কেমন করে মাথার ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়াতে হয় সেইটাই তার বাচ্চাদের দেখাতে লাগল।
জলের ইঁদুর বলল–কী বোকার মতো যে প্রশ্ন কর! আমার অনুগত বন্ধু যে হবে সে আমার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করবে এটা অবশ্যই আমি চাই।
ছোটো-ছোটো পাখনা উড়িয়ে আকাশে ভাসতে-ভাসতে বাচ্চা পাখিটা ডিজ্ঞাসা করল–আর প্রতিদানে কী করতে হবে তোমাকে?
জলের উঁদুর বলল–কী যে ছাই-ভস্ম সব বল আমার তা মাথায় ঢোকে না।
লিনেট বলল–একটা গল্প শোন।
আমার সম্বন্ধে! তাহলে শুনব। গল্প শুনতে আমার খুব ভালো লাগে।
লিনেট বলল–এ গল্প তোমার সম্বন্ধেও খাটবে। এই বলে সে উড়ে গিয়ে পুকুরের ধারে বসে গল্প শুরু করল। এক সময় হ্যানস নামে একটা সৎ জীব বাস করত।
বেশ সম্ভ্রান্ত গোছের?–জিজ্ঞাসা করল জলের ইঁদুর।
লিনেট বলল–না। সদ্য হৃদ্য আর পরিচ্ছন্ন হাসিখুশি ছাড়া তার মধ্যে আর কিছু সম্ভ্রান্ত । ছিল বলে আমার মনে হয় না। একা-একা সে ছোটো একটা ঘরে থাকত; আর প্রতিটি দিনই সে বাগানে কাজ করত। সারা দেশে তার বাগানের মতো সুন্দর বাগান আর কারও ছিল না। সব ঋতুতেই তার বাগানে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে থাকত।
অনেক বন্ধু ছিল মানুষটির; কিন্তু তার সবচেয়ে অনুরক্ত বন্ধু ছিল মিলার হিউ। সত্যি কথা বলতে কি এই ধনী হিউ তার এতই অনুরক্ত ছিল যে এমন কোনো দিন সে বাগানের পাশ দিযে যায়নি যেদিন যে বাগানের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বড়ো একটা সুন্দর ফুলের গুচ্ছ অথবা পকেট ভর্তি করে প্লাম আর চেরি তুলে নিয়ে যায়নি–অবশ্য বাগানে সেগুলি থাকলে।
মিলার হিউ বলত–সত্যিকার বন্ধু তারা যারা একজনের জিনিস সবাই মিলে ভাগ করে নেয়।
এই কথা শুনে হ্যানস হাসত আর ভাবত এত উঁচু আদর্শবাদী বন্ধু আর কার রয়েছে?
মাঝে-মাঝে অনেকেই অবাক হয়ে ভাবত ওই ধনী হিউ, যার কলে একশ বস্তা ময়দা সব সময় মত হয়ে থাকে, যার রয়েছে দু’টা দুধওয়ালা গরু আর লম্বা-লম্বা সুন্দর লোমশ অজস্র ভেড়া–সেই মানুষটি হ্যানসকে প্রতিদানে কখনো কিছু দেয় না কেন। কিন্তু এসবু। ছোটোখাটো ব্যাপার নিযে হ্যানস কোনো দিন মাথা ঘামাত না। বন্ধুদের নিঃস্বার্থপর দানের সম্বন্ধে মিলার হিউ যে সমস্ত লম্বা-লম্বা বক্তৃতা দিত, হ্যানস সেই সব বক্তৃতা খুব মন দিযে শুনত আর উপভোগ করত।
বাগান থেকে হ্যানস যে বিশেষ কিছু পেত তা নয়। শরৎ, গ্রীম আর বসন্তে সে মোটামুটি খুশিই থাকত; কিন্তু শীতকালটাই ছিল তার কাছে মারাত্মক; কারণ, ওই সময়ে তার বাগানে কিছুই ফলত না; অনেকদিন এমনও হয়েছে যে সে কিছু শুকনো ফল মুখে দিয়ে ঘুমোতে গিয়েছে। তা ছাড়া, এই সময়টা সে বড়ো নিঃসঙ্গও বোধ করত, কারণ গোটা শীতকালটা। মিলার হিউও পথ দিয়ে হাঁটত না।
মিলার তার স্ত্রীকে বলত–যতদিন শীত থাকবে ততদিন হ্যানসকে না দেখতে যাওয়াই ভালো। কারণ, মানুষ যখন দুঃখে পড়ে তখন তার কাছে কারও যাওয়া উচিত নয। তাতে তাকে বিব্রত করা হয়। অন্তত, প্রকৃত বন্ধুত্ব বলতে এইটাই আমি বুঝি। আর এ বিষয়ে আমি যে ঠিক সে-সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। সুতরাং বসন্তকাল না আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব; তারপরে আমি দেখা করব তার সঙ্গে। সে তখন আমাকে এক বাক্স প্রিমরোজ উপহার দিয়ে যথেষ্ট আনন্দ পাবে।
প্রচুর পাইন কাঠের আগুনের ধারে মেভাজি একটা আরাম কেদারায় বসে তার স্ত্রী বলল–অন্য লোকের সম্বন্ধে তুমি বেশ চিন্তাশীল দেখছি। বন্ধুত্বের সম্বন্ধে তোমার এই ধরনের। কথা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগছে যদিও পাদরি বাবা বিরাট তিনতলা বাড়িতে থাকেন। এবং কড়ে আঙুলে সোনার আংটি পরেন তবুও আমি নিশ্চিত যে তিনিও এইরকম সুন্দর কথা বলতে পারবেন না।