২. ললিতার স্বপ্ন
০৬.
ললিতার স্বপ্ন দেখছিল অবনী।
দেখছিল: ওরা বিছানায় শুয়ে আছে; ললিতা ছাদের দিকে মুখ তুলে সোজা হয়ে শুয়ে; ললিতার দিকে পাশ ফিরে তার বালিশে কনুই রেখে সামান্য উঁচু হয়ে অবনী। ললিতার চোখ খোলা, ঠোঁট ফাঁক, দুটি সাদা চকচকে দাঁত বেরিয়ে রয়েছে, গলায় তুলসীমঞ্জরীর মতন হার। অবনী ডান হাত আস্তে করে ললিতার মুখের কাছে আনল, গালে ঠোঁটে আঙুলের ডগা বুলোলো, তারপর চোখের পাতা শেষে ডান হাতের পাঁচটি আঙুল ও তালু দিয়ে ললিতার মুখ ঢেকে দিয়ে অবনী ললিতার বুকের ওপর মুখ নামাল। ললিতার হাত অবনীর মাথার চুলে এসে পড়েছে। নিরাচ্ছাদিত বুক ললিতার; অবনী পরিপূর্ণ যুবতীদেহে চুম্বন ও দংশন করল। ললিতা তাকে উৎফুল্ল করছিল, পীড়ন করছিল। তারপর সহসা সে অবনীর আলিঙ্গন থেকে মুক্তির জন্যে বসল। পরমুহূর্তে ললিতাকে আর বিছানায় দেখা গেল না; অবনী অতি দ্রুত তাকে অন্বেষণ করতে ঘরের বাইরে এল। ঘর থেকে অন্য ঘর, বাদুড়বাগানের বাড়ির শোবার ঘরে, ললিতা যেন এইমাত্র এই ঘর থেকে চলে গেছে–তার খোলা জামা কাপড় বিছানায় ও মেঝেতে লুটোচ্ছিল; অবনী চকিতে অন্য ঘরে চলে গেল। স্নানের ঘরে অবিরল জল পড়ছে, পড়ছে… জানলায় জালের পরদা, দরজায় জালের পরদা, দেওয়ালে কোথাও একটু আলো। ললিতা মাথার ওপর শাওয়ার খুলে দাঁড়িয়ে আছে, নগ্ন, পালকের মতন বঙ্কিম নরম পিঠ, কোমর সামান্য ভারী, সদ্যসিক্ত কুম্ভের মতন পিছন, জলের ধারায় জঘা, পায়ের ডিম অস্পষ্ট হয়ে আছে। অবনী এগিয়ে গেল, ললিতার পিছনে; কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে নিজের মুখোমুখি করল। এবং সহসা অনুভব করল সেও নগ্ন। মাথার ওপর কলঘরের ফোয়ারা; জলধারার মধ্যে দাঁড়িয়ে সে দেখল, জলজ প্রাণীর মতন তাদের গায়ে শ্যাওলা ধরে যাচ্ছে, পানা জমে গিয়ে সবুজ কালো হয়ে গেল সব। ললিতা ধাক্কা মেরে তাকে ঠেলে ফেলে দিতে গেল, পারল না; অবনী হাত বাড়িয়ে ললিতাকে সরিয়ে দিতে গেল, পারল না। অবশেষে মাথার ওপরকার ফোয়ারার জলের ধারা হঠাৎ কেমন সুতোর মতন হয়ে মস্ত একটা জাল বোনা হয়ে গেল। শক্ত কালো জাল। কোনও জেলে বিশাল এক জাল ফেলে তাদের যেন ধরে ফেলেছে; সেই জালের মধ্যে শ্যাওলাধরা পানামাখা দুই জলজ প্রাণীর মতন তারা বন্দি। অবনী পাগলের মতন এই জাল কেটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল, ললিতাও দাঁত দিয়ে জাল কাটার চেষ্টা করছে। তারপর দুজনের আপ্রাণ জাল ছিঁড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা…
ঘুম ভেঙে গেল অবনীর। ভেঙে যাবার পরই তার মনে হল সে জাল ছিঁড়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চোখের পাতা খুলল, পাতা খুলতেই বিছানার মশারির জাল দেখল, বাতাসে কাঁপছিল সামান্য; অবনী ভীত ও ত্রস্ত হয়ে ছুটে পালাবার জন্যে উঠে বসে টান মেরে মুখের সামনে থেকে মশারি সরিয়ে ফেলল। এত জোরে সে হাত দিয়ে মশারি টেনে সরাল যে মশারির খানিকটা ছিঁড়ে গেল। ততক্ষণে তার ঘুমের আচ্ছন্ন ভাব এবং ভ্রম ভেঙে গেছে। তবু একবার অবনী বিছানার মধ্যে তাকাল, না–কেউ নেই।
মুখের সামনে থেকে মশারি সরিয়ে অবনী কিছুক্ষণ বসে থাকল, তার শরীরের খানিকটা মশারির মধ্যে, বাকিটা বাইরে। গলায় মুখে ঘাম জমে গেছে। দুঃস্বপ্ন দেখার পর যেভাবে মানুষ তার ভীত, বিমর্ষ ভাবটা ক্রমশ সইয়ে নেয়, অবনী সেইভাবে তার আতঙ্ক ও বিহ্বলতা কাটিয়ে নিচ্ছিল।
শেষে উঠল, বিছানা ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে বাতি জ্বালল। তৃষ্ণায় ঠোঁট গলা শুকিয়ে আছে। অবনী জল খেল, খেয়ে বাথরুমে গেল। ফিরে এসে ঘড়ি দেখল, শেষরাত, চারটে বেজে গেছে। সিগারেট ধরাল। কী মনে করে বাতি নিবিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
এখন সমস্তই নিঃসাড়। বাইরে অন্ধকার। ঠাণ্ডা বাতাস আসছে দমকে দমকে। অন্ধকারে বাগানের গাছপালা ঘন ছায়ার মতন দেখায়, আকাশ কালো, কয়েকটি তারা এখনও চোখে পড়ে।
সিগারেটের ধোঁয়া অবনীর স্নায়ুকে শান্ত ও স্বাভাবিক করছিল। স্বপ্নের উত্তেজনা অবসিত। অথচ তার অন্যমনস্কতা ও বিমর্ষতা বাড়ছিল।
কিছুক্ষণ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল অবনী, সিগারেট শেষ করল, তারপর বিছানায় ফিরে এসে শুয়ে পড়ল।
এই রকম স্বপ্ন সে আর দেখেনি। ললিতাকে কখনও কখনও সে এখনও স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কোনওদিন এভাবে দেখেনি। এই স্বপ্ন, অবনীর মনে হল, অদ্ভুত, ভীতিকর। স্বপ্নে ললিতাকে সাহচর্য সুখ অথবা রমণক্রিয়া হেতু যে হর্ষোৎফুল্লভাব তা সে অনুভব করেছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ হয়। নির্দিষ্ট ও স্থায়ী ছবির মতন অবনী শুধু সেই বীভৎস জালটি দেখতে পাচ্ছিল: কালো, শক্ত, কঠিন; সেই জালের মধ্যে আদিম কোনও জলজ জীবের মতন নগ্ন দুটি নরনারীর সর্বাঙ্গে শ্যাওলা ও পানা। কেন যেন এই স্বপ্নের কোথাও অবনী তার অতীতকে খুঁজছিল।
ললিতার বিষয়ে অবনী আজকাল সাধারণত কিছু ভাবতে চায় না, ভাল লাগে না ভাবতে। তার মনে। হয় না, এখন আর ও-বিষয়ে কিছু ভাববার থাকতে পারে। অকারণে মনে মনে পুরনো বিরক্তিকর একটি স্মৃতিকে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে দেখে লাভ কী! এখনও যে অবনী ললিতার কথা ভাবতে চাইছিল তা নয়, অথচ এই অদ্ভুত স্বপ্নটির রহস্যে ও বিচিত্রতায় সে এতই বিহ্বল ও তন্ময় হয়েছিল যে ললিতার কথা না