- বইয়ের নামঃ বিষাক্ত মদ
- লেখকের নামঃপরেশ সরকার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
বিষাক্ত মদ – পরেশ সরকার
এই পূজা পার্বণের দিনে আবার সাত সকালে মদ গিলে এয়েচো। লজ্জা করে না। এমন ভাতারের মুখে ছাই। বলি কোন লজ্জায় মুখ দেখাও। কথাটা রাগে গজরাতে গজাতে চিৎকার করে বলেছিল সুষমা।
—খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠল শ্রীকান্ত নস্কর। সেই বা কম কিসে। দস্তুর মতো হপ্তা প্রায় সাতশ আটশ টাকা, সুতাকল থেকে। তুই মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষের মতো থাকবি। বেশী ফ্যাচ ফ্যাচ করবিনা তো। আমি কি তোর বাপের টাকায় মদ গিলি। পয়সা উপায় করে খাই। আমাকে বেশি ঘাঁটাবি না বলে দিচ্ছি। মদের তুলনা দিবি না খবরদার।
বলতে আমার বয়েই গেছে? তুই মরবি অকালে। আমার আর কি? ছেলে পুলে নিয়ে পথে বসবো। তোর ছেলেমেয়েরা ভিগ মেগে খাবে। পরের বাড়িতে খুদকুড়ো ভেঙে খাবো। কথা শোনার লোক হলে তো শুনবে। সবই তো আমার কপাল গো। নাহলে এমন মোদোমাতাল ভাতার কারোর কপালে জোটে? বলেই ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো সুষমা।
ছেলেমেয়েরাও বড় হয়েছে। দুটি ছেলে একটি মেয়ে। মেয়েই বড়, ক্লাস নাইনে পড়ে। বাবামায়ের এই কদর্য ঝগড়া দেখে, বিষিয়ে উঠেছে তাদের মন। পরের দুটি ভাই একটি সেভেনে, অন্যটি ফাইভে পড়ে। বাবার এই পুজোর দিনে এভাবে মদ খেয়ে মাতলামি করা, তাদেরও ভাল লাগে না। সূতোকলের কাজ। কখনও ডে ডিউটি কখনও নাইট ডিউটি। আর নাইট ডিউটি হলেই শ্রীকান্ত সকালে বাড়ি ফিরবে টলতে টলতে। তখন বাড়ির সবাই বুঝে ফেলে, বাবা তাদের তৈরি হয়েই এসেছে। ছেলেমেয়েরা চুপচাপ ভয়ে জড়ো হয়ে থাকে। তারা জানে ঈশান কোণে মেঘ জমলে যেন ঝসৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি বাবা মদ খেয়ে ঘরে ঢুকলে মা ঝগড়া করবেই। আর সেই ঝোড়ো ঝগড়া দক্ষযজ্ঞও বাধিয়ে দিতে পারে। আর এসব ভয়াবহ বাবা মায়ের কাণ্ডকারখানা দেখে ছেলেমেয়েরাও বিগড়ে যেতে বসেছে। অথচ সেদিকে বাবা মায়ের খেয়াল নেই। পাড়ায় বাড়িটির নাম হয়ে গেছে, ঝগড়াটে বাড়ি। বড় মেয়ে লীলা পাড়ায় মুখ দেখাতে পারেনা, লজ্জায়। তাকে দেখলেই তার স্কুলের বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে, কিরে, কি নিয়ে তোদের বাড়ি ঝগড়া হচ্ছিল। বাবা মায়ের মধ্যে তো দিনরাত ঝগড়া হয়, তোদের বাড়িতে। তোরা থামাতে পারিস না।
ছেলেমেয়েরা ঝগড়া করলে বাবামায়েরা বকে। ভাইবোনের মধ্যে মারামারি। করলে, বাবামারা মারধোর করে। কিন্তু বাবামায়ের মধ্যে ঝগড়া রাগারাগি হলে, কে তাদের বকবেন। বকার যে কেউ থাকে না। তখন ছেলে আর মেয়েরা দিশেহারা। ছোট ভাই দিদিকে বলল, মা, বাবার ওপর খুব রেগে গেছেরে বড়দি। বড়দি লীলা তাকে বলল, ছোটো চুপ কর। মা রেগে আছে। তোর পিঠেই ভাদ্দরে তাল ফেলবে। ভ্যাবাচেকা খাওয়া ছেলেমেয়েরা একেবারে কেঁচো হয়ে গিয়েছিল। মায়ের অশ্রাব্য গালাগাল শুনে—আর সুষমা তার দজ্জাল গলায় তখনও সমানে গালি দিয়ে যাচ্ছে, শ্রীকান্তকে শুনিয়ে শুনিয়ে। মদ্দ মানুষ হয়েছে গো। হপ্তা পাওয়া টাকার অর্ধেকটা মদ গিলে শেষ করে এসে আমাকে কিছু টাকা ছুঁড়ে দিল। তুমি শালা সংসার সামলাও, চোদ্দগুষ্ঠির পিণ্ডির যোগাড় আর আমি করতে পারবো না, বলে দিলাম। বাবু আমার নবাবপুর। বন্ধু বান্ধবদের মদ গিলিয়ে টাকা সাবাড় করে দিচ্ছে। আমি কি এ সংসারের ঝি চাকর নাকি? রইল তোর সংসার পড়ে, যেদিকে দুচোখ যাবে চলে যাবো। এ সংসারের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিই।
আবার কানের কাছে চেল্লাচ্ছ। নাইট ডিউটি সেরে এসে দজ্জাল বউয়ের মুখ ঝাঁপটা খাওয়ার বান্দা এ শর্মা নয়, জেনে রাখো। পোয় থাকো, না হলে কেটে পড়ো। মেয়েমানুষের মোড়লি শোনার মদ্দমানুষ আমি নই, জেনে রাখো।
—কি আমার মন্দ মানুষরে। ভাত দেবার ভাতার নয়, ঠোনা মারার গোঁসাই। কটা টাকা তো দাও ঘ টাকা ফুকিয়ে দিয়ে। কি করে যে সংসার আমি টেনে কষে চালাই, তা ওই জগদিশ্বরই জানেন। মিনসের আমার কথা শোনো। কথা শুনলে গা পিত্তি জ্বলে যায়। অমন সোয়ামীর মুখে নুড়ো জ্বেলে দিই আমি। ভিক্ষে করে খাবো লোকের দরজায় গিয়ে গিয়ে। তবু তোর মত ভাতার আমার দরকার নেই। এর চেয়ে বেধবা থাকা ঢের ভালো।
–আবার সেই গালাগাল পাড়ছে। দ্যাখো বাড়াবাড়ি আর আমি সহ্য করবো না। মুখে রক্ত ভোলা পয়সায় তোমাদের মতো হাতি আর আমি পুষতে পারবো না, পিরবো না। সূতো কলের কাজ রাত জেগে করে এসে দজ্জাল মাগির কথা শুনতে আমি আর পারবো না, সাফ বলে দিচ্ছি। আমার এখন ঘুম পেয়েছে ঘুমাবো। কানের ধারে গজগজ করেছ কি ঠেঙিয়ে বিষ ঝাড়িয়ে দেবো। একবার চিৎকার করে দ্যা বুঝবি ঠ্যালা।
সুষমা গুম হয়ে গেল। ঘুমোত চাইছে বলেই আর কোন উচ্চবাক্য করল না। সুষমা জানে নেশার ঘোরে রাগ চড়ে গেলে, অনেক সময় মারাত্মক কাণ্ড করে ফ্যালে। এটা ওটা ভেঙে বাড়ি জিনিসপত্র তছনছ করে দিতে পারে। এতক্ষণ যে বাড়িতে দাঙ্গা চলছিল বোঝবার জো টি নেই। সুষমা রাগে গুম হয়ে বসেছিল দাবার কোণে। বড়মেয়ে লীলা গিয়ে রান্নাবান্নার কাজ শুরু করে দিল। নাহলে বাড়িতে অরন্ধন হয়ে যাবে। আর ভাতের হাঁড়ি চড়বে না উনুনে। বাড়িতে বাবা মায়ের ঝগড়া কি ভয়ঙ্কর অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় তা তাদের জানা। সারা বাড়ির সবাইয়ের উপোস অবস্থা থেকে বাঁচানোর একমাত্র অবলম্বন তখন বড় মেয়ে লীলা। তারপর সাধাসাধি করে বাবামাকে, তাকেই খাওয়াতে হয়। ঝোড়ো ঝগড়ার মধ্যে তিন ভাইবোনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।