- বইয়ের নামঃ রমা
- লেখকের নামঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মুঠোবই
- বিভাগসমূহঃ নাটকের বই
রমা – ১.১
রমা
নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিগণ
পুরুষ
বেণী ঘোষাল জমিদার
রমেশ ঘোষাল ঐ খুল্লতাত-পুত্র
মধু পাল মুদী
বনমালী পাড়ুই হেডমাস্টার
যতীন … যদুনাথ মুখুয্যের কনিষ্ঠ পুত্র, রমার ভাই
গোবিন্দ গাঙ্গুলী
ধর্মদাস চাটুয্যে
ভৈরব আচার্য গ্রামবাসিগণ
দীননাথ ভট্টাচার্য
ষষ্ঠীচরণ
পরাণ হালদার
ভজুয়া রমেশের হিন্দুস্থানী দরোয়ান
গোপাল সরকার ঐ সরকার
দীনু ভট্টাচার্যের ছেলে-মেয়েরা, ময়রা, ভৃত্য, খরিদ্দারগণ, বাঁড়ুয্যে, নাপিত, যাত্রী, কর্মচারী, ভিখারিগণ, কুলদা, কৃষকগণ, আকবর, গহর, ওসমান, বৈষ্ণব, সরকার, সনাতন হাজরা, জগন্নাথ, নরোত্তম, দরোয়ান, ইত্যাদি।
স্ত্রী
বিশ্বেশ্বরী বেণীর মা
রমা যদু মুখুয্যের কন্যা
রমার মাসি, সুকুমারী, ক্ষান্ত, খেঁদী, নন্দর মা, ভিখারিণীগণ, বৈষ্ণবী, লক্ষ্মী, ইত্যাদি।
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
[৺যদুনাথ মুখুয্যে মহাশয়ের বাটীর পিছনের দিক। খিড়কির দ্বার খোলা, সম্মুখে অপ্রশস্ত পথ। চারিদিকে আম-কাঁঠালের বাগান এবং অদূরে পুষ্করিণীর বাঁধানো ঘাটের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। সকালবেলায় রমা ও তাহার মাসী স্নানের জন্য বাহির হইয়া আসিল এবং ঠিক সেই সময়েই বেণী ঘোষাল আর একদিক দিয়া প্রবেশ করিল। রমার বয়স বাইশ-তেইশের বেশি নয়। অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছিল বলিয়া হাতে কয়েকগাছি চুড়ি ছিল, এবং থানের পরিবর্তে সরু পাড়ের কাপড় পরিত। বেণীর বয়সও পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের অধিক হইবে না]
বেণী। তোমার কাছেই যাচ্ছিলেম রমা।
মাসী । তা খিড়কির দোর দিয়ে কেন বাছা?
রমা। তোমার এককথা মাসী । বড়দা ঘরের লোক, ওঁর আবার সদর-খিড়কি কি? কিছু দরকার আছে বুঝি? তা ভেতরে গিয়ে একটু বসুন না, আমি চট করে ডুবটা দিয়া আসি।
বেণী। বসবার জো নেই দিদি, ঢের কাজ। কিন্তু কি করবে স্থির করলে?
রমা। কিসের বড়দা?
বেণী। আমার ছোটখুড়োর শ্রাদ্ধের কথাটা বোন। রমেশ ত কাল এসে পৌঁছেছে। বাপের শ্রাদ্ধ নাকি খুব ঘটা করেই করবে। যাবে নাকি?
রমা! আমি যাবো তারিণী ঘোষালের বাড়ি!
বেণী। সে ত জানি দিদি, আর যেই কেন না যাক, তোরা কিছুতেই সে বাড়িতে পা দিবিনে। তবে শুনতে পেলাম ছোঁড়া নিজে গিয়ে সমস্ত বাড়ি-বাড়ি বলে আসবে। বজ্জাতি বুদ্ধিতে সে তার বাপের ওপরে যায়। যদি সত্যই আসে কি বলবে?
রমা। আমি কিছুই বলবো না বড়দা,—বাইরের দরোয়ান তার জবাব দেবে।
মাসী । দরোয়ান কেন লা, আমি বলতে জানিনে? নচ্ছার ব্যাটাকে এমনি বলাই বোলব যে, বাছাধন জন্মে কখনো আর মুখুয্যেবাড়িতে মাথা গলাবে না। তারিণী ঘোষালের ছেলে ঢুকবে নেমন্তন্ন করতে আমার বাড়িতে! আমি কিছুই ভুলিনি বেণীমাধব। তারিণী এই ছেলের সঙ্গেই আমার রমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। তখনো ত যতীন জন্মায় নি, ভেবেছিলো যুদু মুখুয্যের সমস্ত বিষয়টা তা হলে মুঠোর মধ্যে আসবে। বুঝলে না বাবা বেণী!
বেণী। বুঝি বৈ কি মাসী, সব বুঝি।
মাসী । বুঝবে বৈ কি বাবা, এ ত পড়েই রয়েচে। আর তা যখন হল না তখন ঐ ভৈরব আচায্যিকে দিয়ে কি-সব জপ-তপ, তুকতাক করিয়ে মায়ের কপালে আমার এমনি আগুন জ্বেলে দিলে যে, ছ’মাস পেরুল না বাছার হাতের নোয়া মাথার সিঁদুর ঘুচে গেল। ছোট জাত হয়ে চায় কিনা মুখুয্যের মেয়েকে বৌ করতে! তেমনি হারামজাদার মরণও হয়েছে। সদরে গেল মকর্দমা করতে আর ঘরে ফিরতে হল না। এক ব্যাটা, তার হাতের আগুনটুকু পর্যন্ত পেলে না। ছোট জাতের মুখে আগুন!
রমা। কেন মাসী, তুমি লোকের জাত তুলে কথা কও? তারিণী ঘোষাল বড়দারই ত আপনার খুড়ো। বামুন মানুষকে ছোট জাত বল কি করে? তোমার মুখে যেন কিছু বাধে না।
বেণী। (সলজ্জে) না রমা, মাসী সত্যি কথাই বলচেন। তুমি কতবড় কুলীনের মেয়ে, তোমাকে কি আমরা ঘরে আনতে পারি বোন? ছোটখুড়োর এ কথা মুখে আনাই বেয়াদবি। আর তুকতাকের কথা যদি বল ত সে সত্যি। দুনিয়ায় ছোটখুড়ো আর ভৈরবের অসাধ্য কাজ কিছু নেই। রমেশ আসতে না আসতেই ঐ ব্যাটাই ত জুটে গিয়ে হয়েছে তার মুরুব্বি।
মাসী । সে ত জানা কথা বেণী। ছোঁড়া বছর দশ-বারো ত দেশে আসেনি।—সেই যে মামারা এসে কাশী না কোথায় নিয়ে গেল আর কখনো এ মুখো হতে দিলে না। এতকাল ছিল কোথায়? করছিল কি?
বেণী। কি করে জানবো মাসী! ছোটখুড়োর সঙ্গে তোমাদেরও যে ভাব আমাদেরও তাই। শুনচি, এতদিন বোম্বাই না কোথায় ছিল। কেউ বলচে ডাক্তারি পাস করেচে, কেউ বলচে উকিল হয়েচে,—আবার কেউ বলচে সব ফাঁকি। ছোঁড়া নাকি পাঁড় মাতাল। যখন বাড়ি এসে পৌঁছল, তখন চোখ-দুটো ছিল নাকি জবাফুলের মত রাঙা।
মাসী । বটে! তা হলে ত তাকে বাড়ি ঢুকতে দেওয়াই যায় না।
বেণী। কিছুতে না। হাঁ রমা, তোমার রমেশকে মনে পড়ে?
রমা। (সলজ্জ মৃদু হাসিয়া) এ ত সেদিনের কথা বড়দা। তিনি আমার চেয়ে বছর-চারেকের বড়। এক পাঠশালায় পড়েচি, একসঙ্গে খেলা করেচি, ওঁদের বাড়িতেই ত থাকতাম। খুড়ীমা আমাকে মেয়ের মত ভালবাসতেন।
মাসী । তার ভালবাসার মুখে আগুন। ভালবাসা ছিল কেবল কাজ হাসিল করবার জন্যে। তাদের ফন্দিই ছিল কোনমতে তোকে হাত করা। কম ধড়িবাজ ছিল রমেশের মা!
বেণী। তাতে আর সন্দেহ কি। ছোটখুড়ীও যে—
রমা। দেখো মাসি, তোমাদের আর যা ইচ্ছে বল, কিন্তু খুড়ীমা আমার স্বর্গে গেছেন, তাঁর নিন্দে আমি কারও মুখ থেকেই সইতে পারবো না।