শবনম – সৈয়দ মুজতবা আলী এর লেখা অনেক জনপ্রিয় একটি উপন্যাস। শবনম সৈয়দ মুজতবা আলীর সৃষ্ট এক অনবদ্য কাল্পনিক চরিত্র। শবনম চরত্র দ্বারা লেখক এক চিরবহমান প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন যাহা রাধা-কৃষ্ণ কিংবা শিরি-ফরহাদের প্রেমের চিরায়ত ধারা। শবনম বইটি ২০১৪ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশ করেন। তার আগে ১৯৬০ সালে বইটি প্রথম ত্রিবেণী প্রকাশন দ্বারা প্রকাশিত হয়।
শবনম বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ শবনম
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.১ বাদশা আমানুল্লাহর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ
বাদশা আমানুল্লাহর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ। না হলে আফগানিস্তানের মত বিদকুটে গোড়া দেশে বল-ডান্সের ব্যবস্থা করতে যাবেন কেন? স্বাধীনতা দিবসে পাগমান শহরে আফগানিস্তানের প্রথম বল-ডান্স হবে।
আমরা যারা বিদেশী তারা এ নিয়ে খুব উত্তেজিত হইনি। উত্তেজনাটা মোল্লাদের এবং তাদের চেলা অর্থাৎ ভিশতি, দর্জী, মুদী, চাকর-বাকরদের ভিতর।
আমার ভৃত্য আবদুর রহমান সকাল বেলা চা দেবার সময় বিড়বিড় করে বললে, ‘জাত ধম্মো আর কিছু রইল না।’
আবদুর রহমানের কথায় আমি বড় একটা কান দিই নে। আমি শ্রীকৃষ্ণ নই; জাত ধম্মো বাঁচাবার ভার আমার স্কন্ধে নয়।
‘ধেঁড়ে ধেঁড়ে হুনোরা ডপকি ডপকি মেনিদের গলা জড়িয়ে ধেই ধেই করে নৃত্য করবে।’
আমি শুধালুম, ‘কোথায়? সিনেমায়?’
আর আবদুর রহমানকে পায় কে? সে তখন সেই হবু ডান্সের যা একখানা সরেস রগরগে বয়ান ছাড়লে, তার সামনে রোমান কুকর্ম কুকীর্তি শিশু। শেষটায় বললে, “রাত বারোটার সময় সমস্ত আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়। আর তারপর কি হয় দেব আমি জানি নে হুজুর।”
আমি বললুম, তোমার তাতে কি, ভেটকি-লোচন?
আবদুর রহমান চুপ করে গেল।‘ভেটকি লোচন’, ‘ওরে আমার আহ্লাদের ফুটো ঘটি’ এসব বললেই আবদুর রহমান বুঝতে পারত বাবু বদমেজাজে আছেন। এগুলো আমি মাতৃভাষা বাঙলাতেই বলতুম। আবদুর রহমান ঝাণ্ডু লোক; বাঙলা না বুঝেও বুঝত।
ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় সন্ধ্যার সময় বেরিয়েছি। পাগমানের ঝোপে ঝাপে হেথা হোথা বিজলী বাতি জ্বলছে। পরিষ্কার তকতকে ঝকঝকে পিচ-ঢালা রাস্তা। আমি আপন মনে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি, এটা হল ভাদ্দোর মাস। কাল জন্মাষ্টমী গেছে। আমার জন্মদিন। মার মুখে শোনা। এখন সিলেটে নিশ্চয়ই জোর বৃষ্টি হচ্ছে। মা দক্ষিণের ঘরের উত্তরের বারান্দায় মোড়ার উপর বসে আছে। তার কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে চম্পা তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর হয়তো বা জিজ্ঞেস করছে, ‘ছোঁট মিয়া ফিরবে কবে?’
বিদেশে বর্ষাকাল আমার কাল। কাবুল কান্দাহার জেরুজালেম বার্লিন কোথাও মনসূন নেই। ভাদ্দোর মাসের পচা বিষ্টিতে মা অস্থির। তার নাইবার শাড়ি শুকোচ্ছে না, ভিজে কাঠের ধূয়োয় তিনি পাগল, আর আমি দেখছি হুড়মুড় করে বৃষ্টি নেমে আসছে, খানিকক্ষণ পরে আবার রোদ। আঙ্গিনার গোলাপ গাছে, রান্নাঘরের কোণে শিউলি গাছে, পিছনের চাউর গাছের পাতায় পাতায় খুশীর ঝিলিমিলি।
এখানে সে শ্যামল-সুন্দরের দর্শন নেই।
সর্বনাশ! পথ হারিয়ে বসেছি। রাত ন’টা। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। কাকে পথ শুধোই! ডান দিকে ঢাউস ইমারতে নাচের ব্যাণ্ডো বাজছে।
ওঃ! এটা তা হলে আমার ভৃত্য আবদুর রহমান খান বর্ণিত সেই ডান্স হল। এ বাড়ির খানসাম-বেয়ারা তা হলে আমাকে হোটেলের পথটা বাৎলে দিতে পারবে। পিছনের চাকর-বাকরদের দরজার কাছে যাই।
গেলুম।
এমন সময় গটগট করে বেরিয়ে এলেন এক তরুণী।
প্রথম দেখেছিলুম কপালটি। যেন তৃতীয়ার ক্ষীণচন্দ্র। শুধু, চাদ হয় চাপা বর্ণের, এর কপালটি একদম পাগমান পাহাড়ের বরফের মতই ধবধবে সাদা। সেটি আপনি দেখেন নি? অতএব বলব নির্জলা দুধের মত। সেও তো আপনি দেখেন নি। তা হলে বলি বন-মল্লিকার পাপড়ির মত। ওর ভেজাল এখনো হয় নি।
নাকটি যেন ছোট বাঁশী। ওইটুকুন বাঁশীতে কি করে দুটো ফুটো হয় জানি নে। নাকের ডগা আবার অল্প অল্প কাঁপছে। গাল দুটি কাবুলেরই পাকা আপেলের মত লাল টুকটুকে, তবে তাতে এমন একটা শেড রয়েছে যার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় এটা রুজ দিয়ে তৈরী নয়। চোখ দুটিনল না সবুজ বুঝতে পারলুম না। পরণে উত্তম কাটের গাউন। জুতো উচু হিলের।
রাজেশ্বরী কণ্ঠে হুকুম ঝাড়লে, ‘সর্দার আওরঙ্গজেব খানের মোটর এদিকে ডাক তো’।
আমি থতমত খেয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলুম।
মেয়েটি ততক্ষণে আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছে আমি হোটেলের চাকর নই। তারপর বুঝেছে, আমি বিদেশী। প্রথমটায় ফরাসীতে বললে, ‘জ্য ভূ দমাঁদ পারদো, মঁসিয়ে—মাফ করবেন—’ তারপর বললে ফার্সীতে।
আমি আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফার্সীতেই বললুম, ‘আমি দেখছি।’
সে বললে, ‘চলুন।’
বেশ সপ্রতিভ মেয়ে। বয়স এই আঠারো ঊনিশ।
পার্কিঙের জায়গায় পৌঁছনর পূর্বে বললে, “না, আমাদের গাড়ি নেই।”
আমি বললুম, ‘দেখি, অন্য কোন গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি কি না।’
নাসিকাটি ইঞ্চি খানেক উপরের দিকে তুলে মুখ বেঁকিয়ে অত্যন্ত গাঁইয়া ফার্সীতে বললে, ‘সব ব্যাটা আনাচে কানাচে দাড়িয়ে বেলেল্লাপনা দেখছে। ড্রাইভার পাবেন কোথায়?’
আমার মুখ থেকে অজানতে বেরিয়ে গেল ‘কিসের বেলেল্লাপনা?’
মেয়েটি ঘুরে আমার দিকে মুখোমুখি হয়ে এক লহমায় আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত মেপে নিলে। তারপর বলল, ‘আপনার কোনো তাড়া না থাকলে চলুন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন।’