- বইয়ের নামঃ রাজা উজির
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অভাবে শয়তানও মাছি ধরে খায়
অভিজ্ঞতাজনিত বিজ্ঞতা আসে ল্যাটে। তখন ওটা আর কোনও কাজে লাগে না। বিলকুল বেকার। কীরকম? প্রকৃতির নিয়ম : মাথায় বিপর্যয় টাক পড়ে যাওয়ার পর চিরুনি-প্রাপ্তি। ইরানি কবি একটু ঘুরিয়ে বলেছেন : বৃদ্ধ বয়সে অনুশোচনায় দাঁত কিড়মিড় করছি। কিড়মিড় করার জন্য, হায়, দাঁতও যে আর নেই।
ল্যাটে বুঝলুম, মাতৃভাষা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর নিতান্তই যদি আরেকটি ভাষা শিখতে হয় তবে সেটি হবে, তোমার মাতৃভাষা যার কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণী সেইটি শেখা : বাঙলার বেলা সংস্কৃত, ফারসির বেলা আরবি, ফরাসির বেলা লাতিন। তার বেশি ভাষার পিছনে ছুটোছুটি করা নিছক আহাম্মুকি। মাসান্তে যে দু-একখানা বিদেশি বই কিনবে, তার আর উপায় রইল ন! কেন?– কলকাতাতে কি বিদেশি বই পাওয়া যায় না? পাওয়া যায় বইকি, এন্তের অঢেল। অল ইন্ডিয়া রেডিও তো দিবারাত্তির গান গাইছে। মুশকিল শুধু, আপনার পছন্দের গান গায় না।
ইতোমধ্যে আমি দু-খানি চিঠি পেয়েছি। দুটি তরুণ আমার সদুপদেশ পাওয়ার পূর্বেই ফরাসি জৰ্মনে সার্টিফিকেট নিয়ে বসে আছে। তাদের সামনে সমস্যা, এখন এগোয় কী প্রকারে? তারা থাকে মফস্বলে–কী করে বলি, কলকাতার কোনও কোনও লাইব্রেরির লেনডিং সেকশন আছে, তাদের শরণাপন্ন হও, যখন জানি, কলকাতার খাস বাসিন্দার পক্ষেও কর্মটি সুকঠিন।
তখন হঠাৎ খেয়াল গেল, এরা মফস্বলে বাস করে। তার একটা মস্ত সুবিধে, ইলেকট্রিকের উৎপাত সেখানে নেই, কিংবা নগণ্য। বেতারযন্ত্রটির পুরো ফায়দা সেখানে ওঠানো যায়। কলকাতাবাসীও অবশ্য খানিকটে পারবে।
উপস্থিত বেতার খুললেই শর্টওয়েভে পাবেন, গাক গাঁক করে আপন পরিচিতি জানাচ্ছেন চীন (চীন আমাদের অতি কাছে বলেই তাকে পাওয়া যায় হরবকৎ, কিন্তু আমাদের কাজে লাগে অত্যল্পই), রুশ, আমেরিকা (VOA = Voice of America), ব্রিটেন (BBC), এবং অস্ট্রেলিয়া। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের যেগুলো দরকার, যেমন ফ্রান্স, জর্মনি, ইতালি সেগুলো জোরদার নয় এবং আমাদের উপকারার্থে তারা ব্রডকাস্ট করে অল্প সময়।
এই বেতারের সাহায্যে পুস্তকের অভাব খানিকটা পুষিয়ে নেওয়া যায়।
এর পূর্বে দু-একটি কথা অবতরণিকা হিসেবে বলে নেওয়া ভালো।
ভারতবর্ষে যে নিরক্ষরতা দ্রুতগতিতে লোপ পাচ্ছে না, তার প্রধান কারণ এ নয় যে, গ্রামে গ্রামে আমরা পাঠশালা খুলতে পারছিনে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার আসল কারণ, যারা পাঠশালা পাস করে বেরোয় তারা পুনরায় নিরক্ষর হয়ে যায় পড়বার জন্য বই খবরের কাগজের অভাবে। যে গ্রামে পঞ্চাশ বছর ধরে পাঠশালা আছে, সেখানে যে কোনও সময়ে অনুসন্ধান করলে দেখতে পাবেন, মাত্র যারা দু-এক বছর হল পাস করে বেরিয়েছে তারাই এখনও লিখতে পড়তে আঁক কষতে পারে (থ্রি আর= রিডিং, রাইটিং, রেকনিং)। বাদবাকিরা কিংবা তাদের অধিকাংশ পুনরায় নিরক্ষর হয়ে গিয়েছে। এই বিষয় নিয়ে বছর কুড়ি পূর্বে আমি সপ্তাহের পর সপ্তাহ জোর প্রোপাগান্ডা-ক্যামপেন চালিয়েছিলুম; সুযোগ পেলে মৃত্যুর পূর্বে আরেকবার চালাব– মা ফলেষু কদাচন মন্ত্র স্মরণ করে।
তাই বছ, তুমি যে ফরাসি, জর্মন বা রুশ ভাষায় সার্টিফিকেট পেয়েছ সেটা উত্তম কর্ম, কিন্তু যেটুকু শিখেছ সে-ও ভুলে যাবে, ওই গ্রামের পড়ুয়ার মতো পুস্তকাভাবে। তাই বলছিলুম, বেতার তোমাকে খানিকটে বাঁচাতে পারে।
তার পূর্বে কিন্তু একটি ভেরি ভেরি ইম্পরটেন্ট তত্ত্বকথা বলে নিই। এটা আমার নিজের উপদেশ নয়– পৃথিবীর যে কোনও বেতারকেন্দ্র তোমাকে এই উপদেশ দেবে।
রুম অ্যারিয়েল শর্টওয়েভের জন্য সম্পূর্ণ বেকার না হলেও ছাতের উপর বাঁধা দীর্ঘ, দীর্ঘতম বাঁশের অ্যারিয়েলের তুলনায় নগণ্য। আমার উপদেশে যারাই কান পাতছ, তাদেরই বলি, যারা মফস্বলে থাকো তারা নেবে দীর্ঘতম বাঁশ (শহরে বোধহয় এর একটা সীমা আছে, কিন্তু যেহেতু তুমি চোদ্দতলা বাড়িতে বাস কর না, সেটা তোমার ওপরে প্রযোজ্য নয়) এবং নির্মাণ করবে সর্বোত্তম অ্যারিয়েল। এস্থলে বলে রাখা ভালো, তিন-চারশো টাকা সেট + আউটসাইড ব্যামবু অ্যারিয়েলে যে রিসেপশন পাবে, হাজার টাকা সেট+রুম অ্যারিয়েলে পাবে তার চেয়ে ঢের নিকৃষ্ট রিসেপশন। অবশ্য দামি সেটে যে-রকম ধ্বনিকে–বিশেষ করে সঙ্গীতের বেলায় ইচ্ছেমতো কড়া মোটা করা যায়, সস্তা সেটে সেটা করা যায় না। কিন্তু ভাষার বেলা– যাকে বলে স্পোকেন ওয়ার্ড– সস্তা সেটও+দীর্ঘতম আউটসাইড অ্যারিয়েল ১০০% কাজ দেবে। আমার সেট আরও দামি হলে আরও ভালো রিসেপশন হত এটা ভুল ধারণা। যে কোনও দিন সকাল সাতটা-আটটা গোছ সময় ১৩ মিটার ব্যান্ডে অস্ট্রেলিয়া শুনে নিয়ে (ওই সময় ১৩ মিটার মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট) অন্য বাড়িতে দামি সেট শুনে এস- দেখবে তফাৎ নেই। পুনরায় সন্ধে ৬-৩০-এ ১৩ মিটারে প্যারিসের ইংরেজির প্রোগ্রাম খানিকটা শুনে (প্রোগ্রাম মাত্র আধ ঘন্টার, ৭টা থেকে ফরাসি ভাষাতে প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যায়) দামি সেটের রিসেপশনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখ। প্যারিস দুলা স্টেশন, তদুপরি ওই সময় ১৩ মিটারে বিস্তর স্টেশন ঝামেলা লাগায় গোটা তিনেক বিবিসি, একটা vOA, ভাটিকান, সুইজারল্যান্ড, পাকিস্তান, রুশ, হল্যান্ড, আরও কে কে আছেন– কাজেই তুমি যদি তখন প্যারিসের ইংরেজি প্রোগ্রাম পরিষ্কার বুঝতে পার তবে আর চিন্তা কর না, তোমার সেট এবং অ্যারিয়েল দুই-ই ঠিক। অবশ্য বর্ষার অতি নিকৃষ্ট আবহাওয়া হলে দামি, সস্তা কোনও সেটেই, শহর মফস্বল কোনও জায়গাতেই হয়তো প্যারিস ধরতে পারবে না।