বাঈজী
আনোয়ারীবাঈ ঘরে ঢুকতেই মনোহরপ্রসাদ উঠে দাঁড়াল। হাত কপালে ঠেকিয়ে অভিবাদন করল, তারপর নিজের মেহেদীপাতার রংয়ে ছোপানো শাড়িতে হাত বোলাতে লাগল।
আনোয়ারীবাঈ কার্পেটের ওপর বসলেন। মনোহরপ্রসাদের মুখোমুখি আজকাল বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। কোমর টন টন করো বাতের মরসুম শুরু হয়েছে। ভরা শীতকালে আর উঠে হেঁটে বেড়াতে দেবে না। মাঝে মাঝে আনোয়ারীবাঈয়ের খুবই আশ্চর্য লাগে। মনেই হয় না, বছর বারো আগে হাঁটু মুড়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান গেয়েছেন। রাত ভোর হয়ে গিয়েছে ঠুংরী আর গজলে। এখন একটা দুটো গান গাইতে গেলেই হাঁপ ধরে।
কি ব্যাপার ভাইসায়েব, ভোর ভোের? আনোয়ারীবাঈ চুল-সরু খাঁজ ফেললেন কপালে। এত ভোরে ঘুম ভাঙানোতে মেজাজ খুশনয় মোটেই।
একটা জরুরী খবর ছিল, মনোহরপ্রসাদ দাড়ি ছেড়ে হাঁটুতে হাত বোলাতে আরম্ভ করল। মুখে একটু হাসি হাসি ভাবা
আগের দিন ঠিক এমনিভাবেই মনোেহরপ্রসাদ খবর আনতা ছিপছিপে ফরসা চেহারা, হাতের ছোঁয়ায় তবলা যেন কথা বলতা মুজরো নিয়ে বাইরে যাবার সময় আনোয়ারীবাঈ সব সময়ে মনোহরপ্রসাদকে সঙ্গে নিতে কোন ঝামেলা নেই, বদ অভ্যাস নয়। ঘাড় হেঁট করে নিজের কাজ করে যেত। আনোয়ারীবাঈয়ের শুধু তবলচীই ছিল না মনোহরপ্রসাদ, এধার ওধার থেকে খবরের টুকরোও সেই সংগ্রহ করত।
আজ রায়-বেরিলির খানসায়েব এসেছেন। এখানে থাকবেন হপ্তা খানেক। খানসায়েব ঠুংরীর বড় ভক্ত, দেখি একবার যোগাযোগ করে। কাল পরশু আপনার কোন বায়না নেই তো কোথাও?
মনোহরপ্রসাদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে চাইত আনোয়ারীবাঈয়ের দিকে না, বায়না আর কোথায়, আনোয়ারীবাঈ ঘাড় নাড়তেন, বায়না থাকলে আর তুমি জানতে পারতে না?
তা ঠিক। মনোহরপ্রসাদও ঘাড় নেড়েছে। এমনি নানা খবর।
আজ রাতে মীর্জা হোসেন আসবেন গান শুনতে সন্ধ্যার ঝোঁকে মনোহরপ্রসাদ সংবাদ আনল।
আজ রাতে? সর্বনাশ! বিস্ময়ে আনোয়ারীবাঈ চোখ কপালের মাঝ বরাবর তুলেছেন,…আজ যে ডাক্তার জনার্দন সুকুল আসবেন, তিনদিন আগে খবর পাঠিয়েছিলেন।
ও ঠিক আছে, নিস্পৃহ গলায় উত্তর দিয়েছেন মনোহরপ্রসাদ আমি তাঁকে বারণ করে এসেছি। বলেছি আপনার তবিয়ৎ খারাপ দিন সাতেক পরে আসর বসবো
কিন্তু কাজটা কি ঠিক হল ভাইসায়েব? আনোয়ারীবাঈ আমতা আমতা করেছেন।
মীর্জা হোসেন কাল সকালে হায়দ্রাবাদ ফিরে যাচ্ছেন। বছর খানেকের আগে আর এ মুখো হবেন না। আর সুকুল সায়েব তো ঘরের লোকা।
আনোয়ারীবাঈ রাজী। কোনদিন মনোহরপ্রসাদের কথার ওপর কথা বলেন নি। এটুকু জানতেন, মনোহরপ্রসাদ যা করবে আনোয়ারীবাঈয়ের ভালোর জন্যেই নিজের দিকে চাইবে না, গায়েও মাখবে না দুঃখ কষ্ট। সুকুল সায়েবের চেয়ে মীর্জা হোসেন পয়সা কম ঢালবে বলে নয়, হোসেন সায়েব গানের অনেক বেশি সমঝদার। ঠিক জায়গায় তারিফ করতে জানেন, বুঝতে পারেন গলার সূক্ষ্ম কাজের কেরামতি সুকুল সায়েবের এ সবের বালাই নেই। গান শুরু হতেই তাকিয়া ঠেস দিয়ে শুয়ে পড়েন। ঠিক গান শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে ঘাড় নেড়ে বলেন, কেয়াবাত! কেয়াবাত! বড় মিঠে গলা বাঈজীরা ভারি মিঠো।
আজ নিশ্চয় এ সব কথা বলতে মনোহরপ্রসাদ আসে নি। গান ছেড়ে দিয়েছেন আনোয়ারীবাঈ। মনোহরপ্রসাদও আর তবলা ছোঁয় না। গান-বাজনার সম্পর্ক নেই, কিন্তু হৃদয়ের সম্পর্ক ঘোচে নি। সময় পেলেই মনোহরপ্রসাদ ঘুরে যায় একবার পা মুড়ে বসে ফেলে আসা সুখ-দুঃখের গল্প চলে। জমানা বিলকুল বদলে গেছে, সে সম্বন্ধে আক্ষেপ।
আনোয়ারীবাঈ বিস্মিত হলেন, হেসে বললেন, আর জরুরী খবরে দরকার কি ভাইসায়েব। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, এবার যা কিছু জরুরী খবর আসবে একেবারে ওপার থেকে।
মনোহরপ্রসাদ এ কথার কোন উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে কার্পেটের একটা ফুল খুঁটতে খুঁটতে আস্তে বলল, মোতি এসেছে শহরে।
মনোহরপ্রসাদের কথার টুকরো কানে যেতেই আনোয়ারীবাঈ টান হয়ে বসলেন। একটা হাত রাখলেন কানের পাশে মনোহরপ্রসাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, কে এসেছে? কে এসেছে শহরে?
মনোহরপ্রসাদ মাথা তুলল, গলাও চড়াল একটু, মোতি এসেছে, মোতি। খবরের কাগজে বেরিয়েছে মেজর বর্মা লক্ষ্ণৌতে বদলি হয়েছেন।
বুঝতে বেশ একটু অসুবিধা হল আনোয়ারীবাঈয়েরা অস্পষ্ট কতকগুলো হিজিবিজি রেখা। অর্থহীন, সামঞ্জস্যহীন। বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলেন কিছুক্ষণ, মোতি, মোতিবাঈ, মোতিবাঈ এসেছে শহরে।
দু’একদিনের কথা নয়। দেড় যুগের বেশি, তখন কত বয়স মোতিরা বড় জোর পাঁচ কি ছয়। দু পাশে বেণী দোলানো, রঙিন সালোয়ার পাজামা পরা ফুটফুটে মেয়ে। ছুটে ছুটে বেড়াত এ বাড়ি থেকে ও-বাড়ি। দুনিয়ার লোকের সঙ্গে দোস্তি চেয়ে চেয়ে আনোয়ারীবাঈয়ের আশ আর মিটত না। কোনদিন যে মনের মানুষের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল আনোয়ারীবাঈ, পাতানো নয়, সত্যিকারের স্বামী-স্ত্রী, পরের যুগের গজল-ঠুংরী-খেয়ালের সুরে বাঁধা জীবন নয়, পা ফেলা নয় তবলার বোলের তালে পা মিলিয়ে, মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখে ঘেরা জীবন, সামাজিকতার গণ্ডীর মধ্যে সাবধানে পা ফেলে চলা, মোতি আনোয়ারীবাঈয়ের সেই ফেলে আসা জীবনেরই চিহ্ন।