- বইয়ের নামঃ বোম্বাইয়ের বোম্বেটে
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, ফেলুদা সমগ্র
০১. লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু
লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু-র হাতে মিষ্টির বাক্স দেখে বেশ অবাক হলাম! সাধারণত ভদ্রলোক যখন আমাদের বাড়িতে আসেন তখন হাতে ছাতা ছাড়া আর কিছু থাকে না। নতুন বই বেরোলে বইয়ের একটা প্যাকেট থাকে অবিশ্যি, কিন্তু সে তো বছরে দু বার। আজ একেবারে মিজাপুর স্ট্রিটের হালের দোকান কল্লোল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পঁচিশ টাকা দামের সাদা কার্ড বোর্ডের বাক্স, সেটা আবার সোনালি ফিতে দিয়ে বাঁধা। বাক্সের দু পাশে নীল অক্ষরে লেখা কল্লোলস্ ফাইভ মিক্স সুইটমিটস–মানে পাঁচ-মেশালি মিষ্টি। বাক্স খুললে দেখা যাবে। পাঁচটা খোপ করা আছে, তার একেকটাতে একেক রকমের মিষ্টি। মাঝেরটায় থাকতেই হবে কল্লোলের আবিষ্কার ডায়মন্ডা–হিরের মতো পাল-কাটা রুপোর তবক দেওয়া রস-ভরা কড়া পাকের সন্দেশ।
এমন বক্স লালমোহনবাবুর হাতে কেন? আর ওঁর মুখে এমন কেল্লা-ফাতে হাসি হাসি ভাবই বা কেন?
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে বাক্স টেবিলে রেখে চেয়ারে বসতেই ফেলুদা বলল, বোম্বাইয়ের
সুখবরটা বুঝি আজই পেলেন?
লালমোহনবাবু প্রশ্নটা শুনে অবাক হলেও তাঁর মুখ থেকে হাসিটা গেল না, কেবল ভুরু দুটো ওপরে উঠল।
কী করে বুঝলেন, হে হে?
সাইরেন বাজার এক ঘণ্টা পরে যখন দেখছি আপনার হাতঘড়ি বলছে সোয়া তিনটে, তার মানেই টাটকা আনন্দের আতিশয্যে ঘড়িটা পরার সময় আর ওটার দিকে চাইতেই পারেননি। —স্ক্রিপ্রং গেছে, না দম গেছে?
লালমোহনবাবু তাঁর নীল র্যাপারের খসে পড়া দিকটা রোম্যান কায়দায় বাঁ কাঁধের উপর ফেলে দিয়ে বললেন, পঁচিশ চেয়েছিলুম; তা আজ ভোরে ঘুম ভাঙতেই চাকর এসে টেলিগ্ৰাম ধরিয়ে দিলে। এই যে।
লালমোহনবাবু পকেট থেকে একটা গোলাপি টেলিগ্ৰাম বার করে পড়ে শোনালেন—
প্রোডিউসার উইলিং অফার টেন ফর বোম্বেটে, প্লিজ কেবল কনসেন্ট। আমি রিপ্লাই পাঠিয়ে দিয়ে এলুম-হ্যাঁপিলি সেলিং বোম্বেটে ফর টেন টেক ব্লেসিংস।
দশ হাজার! ফেলুদার মতো মাথা-ঠাণ্ডা মানুষের পর্যন্ত চোখ গোল গোল হয়ে গেল। দশ হাজারে গপ্প বিক্রি হয়েছে আপনার?
জটায়ু একটা হালকা মসলিনি হাসি হাসলেন।
টাকাটা হাতে আসেনি এখনও। ওটা বম্বে গোলেই পাব।
আপনি বম্বে যাচ্ছেন? ফেলুদার চোখ। আবার গোল।
শুধু আমি কেন? আপনারাও। অ্যাট মাই এক্সপেনস। আপনি ছাড়া তো এ গপ্প দাঁড়াতই না মশাই।
কথাটা যে সত্যি, সেটা ব্যাপারটা খুলে বললেই বোঝা যাবে।
জটায়ুর অনেক দিনের স্বপ্ন যে তার একটা গল্প থেকে সিনেমা হয়। বাংলা ছবিতে পয়সা নেই, তাই হিন্দির দিকেই ওঁর ঝোঁক বেশি। এবারে তাই কোমর বেঁধে হিন্দি সিনেমার গল্প লেখা শুরু করেছিলেন। বম্বের ফিল্ম লাইনে লালমোহনবাবুর একজন চেনা লোক আছে, নাম পুলক ঘোষাল। আগে গড়পারেই থাকত, লালমোহনবাবুর দুটো বাড়ি পরে। কলকাতায় টালিগঞ্জে তিনটে ছবিতে সহকারী পরিচালকের কাজ করে রোখের মাথায় বম্বে গিয়ে হাজির হয়। সেখানে এখন সে নিজেই একজন হিট ডিরেক্টর।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ অবধি গিয়ে গল্প আর এগোচ্ছে না দেখে জটায়ু ফেলুদার কাছে আসেন! ফেলুদা তখন-তখনই লেখাটা পড়ে মন্তব্য করে–মাঝপথে আটকে ভালই হয়েছে। মশাই! এ আপনার পণ্ডশ্রম হত। বোম্বাই নিত না।
লালমোহনবাবু মাথা চুলকে বললেন, কী হলে নেবে মশাই বলুন তো। আমি তো ভেবেছিলুম খানকতক কারেন্ট হিট ছবি দেখে নিয়ে তারপর লিখব! দু দিন কিউয়ে দাঁড়ালুম; এক’দিন পকেটমার হল, এক’দিন সোয়া ঘণ্টা দাঁড়িয়ে জানলা অবধি পৌঁছে শুনলাম হাউস ফুল। বাইরে টিকিট ব্ল্যাক হচ্ছিল, কিন্তু বারো টাকা খরচ করে শেষটায় কোডোপাইরিন খেতে হবে সেই ভয়ে পিছিয়ে গেলুম।
শেষে ফেলুদাই একটা ছক কেটে দেবে বলল লালমোহনবাবুর জন্য। বলল, আজকাল ডবল রোলের খুব চল হয়েছে, সেটা জানেন তো?
লালমোহনবাবু ডবল রোল কী সেটাই জানেন না।
একই চেহারার দুজন নায়ক হয় ছবিতে সেটা জানেন না? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
যমজ ভাই?
তাও হতে পারে, আবার আত্মীয় নয়। অথচ চেহারায় মিল সেটাও হতে পারে। একই চেহারা, অথচ একজন ভাল লোক, একজন খারাপ লোক; অথবা একজন শক্ত-সমর্থ আর একজন গোবেচারা। সাধারণত এটাই হয়। আপনি একটু নতুনভাবে এক কাঠি বাড়িয়ে করতে পারেন;–একটা ডবল রোলের বদলে এক জোড়া ডবল রোল। এক নম্বর হিরো আর এক নম্বর ভিলেন হল জোড়া, আর দুই নম্বর হিরো আর দুই নম্বর ভিলেন হল আরেক জোড়া! এই দুই নম্বর জোড়া যে আছে, সেটা গোড়ায় ফাঁস করা হবে না। তারপর–
এখানে লালমোহনবাবু বাধা দিয়ে বললেন, একটু বেশি জটিল হয়ে যাচ্ছে না?
ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল, তিন ঘণ্টার মালমশলা চাই। আজকাল নতুন নিয়মে খুব বেশি ফাইটিং চলবে না। কাজেই গল্প অন্যভাবে ফাঁদতে হবে। দেড় ঘণ্টা লাগবে জটি পাকাতে, দেড় ঘণ্টা ছাড়াতে।
তা হলে ডবল-রোলেই কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবে বলছেন?
তা কেন? আরও আছে। নোট করে নিন।
লালমোহনবাবু সুডুৎ করে বুক পকেট থেকে লাল খাতা আর সোনালি পেনসিল বার করলেন।
লিখুন-স্মাগলিং চাই-সোনা হিরে গাঁজা চরস, যা হাক; পাঁচটি গানের সিচুয়েশন চাই, তার মধ্যে একটি ভক্তিমূলক হলে ভাল; দুটি নাচ চাই; খান দু-তিন পশ্চাদ্ধাবন দৃশ্য বা চেজ-সিকুয়েন্স চাই-তাতে অন্তত একটি দামি মোটরগাড়ি পাহাড়ের গা গড়িয়ে ফেলতে পারলে ভাল হয়; অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য চাই; নায়কের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে নায়িকা এবং ভিলেনের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে ভ্যাম্প বা খলনায়িকা চাই; একটি কর্তব্যবোধসম্পন্ন পুলিশ অফিসার চাই; নায়কের ফ্ল্যাশব্যাক চাই; কমিক রিলিফ চাই; গল্প যাতে ঝুলে না পড়ে, তার জন্য দ্রুত ঘটনা পরিবর্তন ও দৃশ্যপট পরিবর্তন চাই; বার কয়েক পাহাড়ে বা সমুদ্রের ধারে গল্পকে নিয়ে ফেলতে পারলে ভাল, কারণ এক নাগাড়ে স্টুডিয়োর বদ্ধ পরিবেশে শুটিং চিত্ৰতারকাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর। —বুঝেছেন তো?