- বইয়ের নামঃ লোটাকম্বল
- লেখকের নামঃ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.০১ যাত্রা শুরু
প্রথম খণ্ড
অবতার বরিষ্ঠায় শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ
মাতাজী
পরমারাধ্যা
ব্রাজিকা মোক্ষত্রণার
শ্রীচরণকমলে
.
যাত্রা শুরু
এ আমার আত্মজীবনী নয় তবে আত্মজীবনীর মত করে লেখা অসংলগ্ন প্রলাপ। বস্তু আছে কি না জানি না তবে বাস্তব কিছু থাকতে পারে। পৃথিবীতে অনেকেই অনেক কিছু করতে আসে। আমার স্কুলের প্রধানশিক্ষক মশাই ক্লাসে এসে প্রায়ই বলতেন, ওরে এসেছিস যখন তখন দেয়ালে একটা। আঁচড় রেখে যা। স্বামী বিবেকানন্দ, যুগাবতার রামকৃষ্ণ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, হুড়হুড় করে একগাদা নাম উচ্চারণ করতে করতে রবীন্দ্রনাথে এসে স্তব্ধ হয়ে যেতেন। চোখ ছলছলে হয়ে উঠত। তারপর চটাক করে সেই চটকা ভেঙে শেষ বেঞ্চের কোণের দিকে বসে থাকা শম্ভু সাঁতরার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলতেন, অ্যায়, উঠে দাঁড়া। শম্ভ কলের পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াত। ইংরিজি কর, রামেরা দুই ভাই। শম্ভ বারকতক রাম নাম করে চেত্তা-খাওয়া ঘুড়ির মতো একপাশে কেতরে পড়ত। সেই বয়েসেই বুঝেছিলুম, ত্রেতায় রাম নামের যথেষ্ট পাওয়ার থাকলেও কলির শেষপাদে একেবারেই শক্তিহীন; কারণ এর পরেই হেডমাস্টারমশাই শম্ভুর পিঠে লিকলিকে বেত দিয়ে সপাসপ আঁচড় কাটতে শুরু করেছেন। এরপর ওই রাম তার যোগ্য ভ্রাতাকে নিয়ে ইংরিজি হবার জন্যে ঘুরে ঘুরে আমাদের সকলের কাছেই আসছে আর আমরা যথারীতি বেত্রাহত হয়ে আঁচড়-কাটা মহাপুরুষ না হয়ে আঁচড়-খাওয়া মানবসন্তান হয়ে নেতিয়ে নেতিয়ে পড়ছি। একটি প্রশ্ন এবং পর্যায়ক্রমে ক্লাসের বড়, ছোট, দামড়া ষাটজন মনুষ্যশাবককে পেটাতে পেটাতেই সময় কাবার হয়ে যেত। টেবলের ওপর বেত ফেলে দিয়ে হেডমাস্টারমশাই কোঁচার খোঁটে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে দিনের শেষ কথাটি বলতেন, তুমি যখন এসেছিলে, তখন তুমি কেঁদেছিলে জগৎ হেসেছিল, তুমি যখন যাবে হাসতে হাসতে যাবে, আর সারা জগৎ তোমার জন্য কাঁদবে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুটি বাতাসা বের করে তিনি মুখে ফেলতে-না-ফেলতেই স্কুলের দারোয়ান এসে বেত, ডাস্টার আর মোটা ডিকশনারিটা তুলে নিয়ে চলে যেত। কাঁধে চাদর ফেলে আমাদের প্রধানশিক্ষক উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে সাবধানে নেমে আসতেন, তারপর আপন মনে আঁচড় কেটে যা আঁচড় কেটে যা বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে চলে যেতেন। আমরা সদলে ডোরা কাটা জেব্রার মতো বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবতুম দাগ রেখে যাওয়া ব্যাপারটা কত সহজ! কিছুই না, একটা বেত আর মনুষ্যরূপী গাধাদের কালো-সাদা পিঠ আর একটি প্রশ্ন। এই তিন মালকে মেলাতে পারলেই মহাপুরুষ। মার খেতে খেতে শম্ভু সত্যিই মহাপুরুষ হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলে তার পিঠের আর কোনও সাড় নেই। মারলেও লাগে না। কানমলার চোটে ডান কান বাঁ কানের চেয়ে দু’সুতো লম্বা হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে সাচ্চা সাধুর মতো সবসময় শালা বেরোচ্ছে।
পেটাই হতে হতে পেটাই হতে হতে, জলছাত তৈরি হয়। গোটা কুড়ি পাঠঠা মেয়েমানুষ জলের আরক ছিটোয়, পিচিক পিচিক করে খইনির থুতু ফেলে আর কাঠের মুগুর দিয়ে পেটাতে থাকে যদ্দিন না পেটাইয়ের কাঠ তড়াং তড়াং করে লাফিয়ে ওঠে। এইভাবে হিট প্রুফ, ওয়াটার প্রুফ ছাদ তৈরি হলেও অভিমানশূন্য মানুষ তৈরি হয় কি? কেরিয়ারও কি তৈরি হয়? হলে আমি সত্যিই মহামানব হয়ে যেতুম। ওটা আলাদা ব্যাপার। আমার সম্পর্কে একদিন একটি মন্তব্য শুনে বড় মুষড়ে পড়লুম। হাজারবার ধুলেও কয়লা সাদা হয় না। পেতল মাজলেও সোনা হয় না। মানুষ নিয়ে আসে। অদৃশ্য একটি পুঁটলি নিয়ে কুঁজো হয়ে অন্ধকার রাতে মাতৃজঠরে মুক্তোর পেটে স্বাতী নক্ষত্রের জলের মতো ঢুকে, ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তারপর একদিন অয়েলক্লথে ওঁয়া ওঁয়া করে গড়িয়ে পড়ে। গর্ভে মহাপুরুষ এলে মায়ের জ্যোতি বেড়ে যায়। শেষরাতে পিতা স্বপ্ন দেখেন, আষ্টেপৃষ্ঠে বটের ঝুরি জড়ানো ভগ্ন দেউল থেকে জ্যোতিষ্মন এক দেবশিশু বেরিয়ে এসে বলেন, আমি তোর কাছে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে পিতার ঘুম ভেঙে যায়। স্বেদ, কম্প, পুলক প্রভৃতি দেখা দেয়। তিনি মাকে ঠেলা মারতে মারতে বলতে থাকেন, ওগো, শুনছ শুনছ, তিনি আসছেন, তিনি আসছেন। শেষের দিকে আনন্দে গলা ভেঙে আটরকম শব্দ বেরোতে থাকে। আগমন সংবাদ অকটেভে খেলে বেড়ায়। ঘুম-চোখে মা হয়তো জিজ্ঞেস করেন, কে আসছে গো? পিতা মশারির মধ্যে গাট হয়ে বসে ভাবাশ্রু বর্ষণ করতে করতে বলেন, যেসাস হতে পারেন, কৃষ্ণের অবতার হতে পারেন, স্বয়ং মহাদেব হতে পারেন। কে বলতে পারে, সময়ের ঘূর্ণনে দ্বিতীয় শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব হচ্ছে কি না! ক্ষুদিরাম তোতা এইভাবেই গদাধরকে পেয়েছিলেন। জগন্নাথ পেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যকে। মায়ের খাতির অমনি বেড়ে যায়। মহাপুরুষের ডিম্ব ধারণ করেছেন। অলৌকিক জ্যোতি দেখা দিয়েছে লৌকিক শরীরে। যৌথ পরিবারের ছাদে ভাদ্রের চাদি-ফাটা রোদে বসে বসে বড়ি কি কয়লার গুল আর দিতে হবে না। বাগানের পাঁচিলে থ্যাপাক থ্যাপাক করে ঘুঁটে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য তলব করা হল। তাঁরা প্রত্যেকেই একবাক্যে ঘোষণা করলেন, এ বস্তুটির আবির্ভাব-মুহূর্তে ছোটবউদির চেহারায় কোনও অলৌকিক পরিবর্তন আসেনি। স্বপ্ন একটা দেখেছিল মনে হয়, বাবা পঞ্চানন ষাঁড়ের পিঠে চেপে আসছেন। পঞ্চাননতলার পঞ্চানন? সে দেবালয় ভেঙে কালের গর্ভে চলে গেছে। তা ছাড়া বাবা পঞ্চাননের তেমন দেবমর্যাদা ছিল না। পূজারি বেচারা গাঁজায় দম মেরে মেরে অকালেই দমহারা হয়ে পরপারে। মনে পড়েছে, তিন বছর বয়েসে ওকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে মাথা ন্যাড়া করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপরেই পুঁয়ে পেয়ে ছেলে শুকোতে লাগল। সাত সমুদ্রের কডলিভার মালিশ করে করে মালিশ করে করে, রোদে ফেলে রাখা হত ধুতি চাপা দিয়ে। কী বরাত! যে বয়েসে শিশু কোলে কোলে, বুকে বুকে ত্যাত্যা, ব্যাব্যা করে বেড়াবে, গোলগাল মোটা মোটা হাতের কচি কচি আঙুল দিয়ে নাক খামচাবে, চশমা ধরে টানবে, সেই বয়েসেই অস্পৃশ্য মৎসগন্ধ হয়ে দাওয়ায় পড়ে রইল। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে কাছে এগোতে হত, এই যে আমার বাবুটা, এই যে আমার ব্যাবাটা। মুখে শিশুর স্বর্গীয় হাসি ছিল না। নাড়গোপালের মতো হামা ছিল না। কোমরের লাল ঘুনসিতে তামার ফুটো পয়সা কাপ হয়ে বসে ছিল না। সংসারের চাতালে এক দুঃস্বপ্নের আবির্ভাব। তিমিরে কডলিভার-মর্দিত তিমিশিশু। হাতে তার গুনচুঁচ। তবিল ফুটো করে সব সঞ্চয় লিক করিয়ে দিলে। এ মহাপুরুষ হল চৌবাচ্চার সেই বিখ্যাত ছেদা। যাঁর আগমনে সংসারটাই ড্যামেজ হয়ে গেল।