- বইয়ের নামঃ লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, ইতিহাস
পূর্বলেখ
যে-রকম বোধ আমাকে কবিতা লিখতে উৎসাহ দেয়, সে-রকম বোধে অনুপ্রাণিত হয়েই, দুদশক আগে, লিখেছিলাম লাল নীল দীপাবলি। একটি দীর্ঘ কবিতার মতোই কয়েক দিনের মধ্যে লাল নীল দীপাবলি রচিত হয়ে উঠেছিলো। আজ আর আমার পক্ষে এ-বই লেখা সম্ভব নয়। এ-বইয়ের পাঠক হিশেবে আমার কল্পনায় ছিলো স্বপ্নকাতর সে-কিশোরকিশোরীরা তরুণতরুণীরা, যারা আছে কোমল কৈশোরের শেষ রেখায়, বা যারা কৈশোর পেরিয়ে ঢুকেছে এক বিস্ময়কর আলোতে, যাদের সৌরলোক ভরে গেছে সাহিত্যের স্বর্ণশস্যে। একদা আমি সবুজ বাল্যকাল পেরিয়ে সাহিত্যের মধ্যে মহাজগৎকে দেখেছিলাম, লাল নীল দীপাবলি তাদেরই জন্যে যারা আজ একদা আমার মতো। তবে তারা কি আজ আছে? শুনতে পাই সময় তাদেরও নষ্ট করেছে, তারা আর সাহিত্যের স্বর্ণশস্যে বুক ভরিয়ে তোলে না। অন্য নানা সোনায় তাদের বুক পরিপূর্ণ। বাঙলা সাহিত্যের দিকে তাকালে এক সময় আমার চোখে শুধু লাল নীল প্রদীপমালার রূপ ভেসে উঠতো, দেখতে পেতাম হাজার বছর ধরে জ্বেলে দেয়া ঝাড়লণ্ঠনের মালা। দীপ জ্বেলেছেন কাহ্নপাদ, দীপ জ্বেলেছেন বড়ু চণ্ডীদাস; হাজার বছর ধরে দীপ জ্বেলেছেন মুকুন্দরাম, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বিহারীলাল, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, ও আরো অনেকে। লাল নীল দীপাবলিতে আমি স্বপ্ননীল কিশোরকিশোরী তরুণতরুণীদের চোখের সামনে বাঙলা সাহিত্যের হাজার বছরকে আলোকমালার মতো জ্বেলে দিতে চেয়েছিলাম। কয়েক বছর আগে আরেকটি বই লিখেছি আমি : কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী। এ-দুটি যুগল বই। আমি চাই এ-দুটি একসাথে থাকুক কিশোেরকিশোরী তরুণতরুণীদের টেবিলে; একটি বলুক সাহিত্যের কথা, আরেকটি বলুক ভাষার কথা। লাল নীল দীপাবলির প্রথম প্রকাশের সময় বিদেশে ছিলাম, তাই রয়ে গিয়েছিলো মুদ্রণটি। সংশোধন করতে গিয়ে এবার বইটি নতুন করে লিখেছি, কোনো কোনো পরিচ্ছেদ হয়েছে আগের থেকে অনেক বড়। লাল নীল দীপাবলি ১৯৭৩-এ ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিলো ‘দৈনিক বাংলা’র ‘সাতভাই চম্পা’য়। এটিকে আমি কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনীর যুগল বই বলে মনে করি বলে এবার এর নামে যোগ হলো বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী। আশা করি এবারও লাল নীল দীপাবলি পাবে কিশোরতরুণদের ভালোবাসা।
হুমায়ুন আজাদ
২৭ পৌষ ১৩৯৮ : ১১ জানুয়ারি ১৯৯২
১৪ই ফুলার রোড : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা
লাল নীল দীপাবলি
যদি তুমি চোখ মেললা বাঙলা সাহিত্যের দিকে, তাহলে দেখবে জ্বলছে হাজার হাজার প্রদীপ; লাল নীল সবুজ, আবার কালোও। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে রচিত হচ্ছে বাঙলা সাহিত্য। এর একেকটি বই একেকটি প্রদীপের মতো আলো দিচ্ছে আমাদের। বুক ভরে যায় সে-আলোকের ঝরনাধারায়; সে-আলোকে ভরে যায় টেবিল, খাতার ধূসর সাদা খসখসে পাতা, পৃথিবী ও স্বপ্নলোক। সাহিত্য হচ্ছে আলোর পৃথিবী, সেখানে যা আসে আলোকিত হয়ে আসে; কালো এসে এখানে নীল হয়ে যায়, অসুন্দর হয়ে যায় সুন্দর শিল্পকলা। বাঙলা সাহিত্যকে এমন সুন্দর করে রচনা করেছেন যুগ যুগ ধরে কতো কবি, কতো গল্পকার। তাঁদের অনেকের নাম আমরা মনে রেখেছি, ভুলে গেছি অনেকের নাম। কিন্তু সকলের সাধনায় গড়ে উঠেছে বাঙলা সাহিত্য। সবাই সমান প্রতিভাবান নন, সময় সকলকে মনে রাখে না। সময় ভীষণ হিংসুটে, সে সব সময়ই বসে আছে একেকজন লেখকের নাম তার পাতা থেকে মুছে ফেলতে। এভাবে মুছে গেছে কতো কবির নাম; কতো লেখকের মুখের ছবি অকরুণ আঙুলে মুছে ফেলেছে সময়। কিন্তু এমন অনেকে। আছেন সময় যাঁদের ভোলে না, বরং তাঁদের নাম সোনার অক্ষরে লিখে রাখে। যেমন বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বিহারীলাল, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের নাম, বা চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, আলাওলের নাম। এঁরা এতো বড়ো যে ভোলা যায় না, বরং তাদের নাম বার বার মনে পড়ে।
সময় থেমে থাকে না, সময়-নদী গোপনে বয়ে যায়। সাহিত্যও সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলে। এভাবেই সাহিত্যের বিকাশ ঘটে, তার রূপান্তর সম্পন্ন হয়। বাঙলা সাহিত্যের প্রথম বইটি হাতে নিলে চমকে উঠতে হয়, এটা যে বাঙলা ভাষায় লেখা সহজে বিশ্বাস হয় না। কেননা হাজার বছর আগে আমাদের ভাষাটিও অন্য রকম ছিলো, তা পরিবর্তিত হতে হতে আজকের রূপ ধরেছে। এক হাজার বছর আগে সাহিত্যও আজকের মতো ছিলো না। আজ যে-সব বিষয়ে সাহিত্য রচিত হয়, তখন সে-সব বিষয় নিয়ে কোনো কবি লিখতেন না। সময় এগিয়ে গেছে, সাহিত্যের জগতে এসেছে নতুন নতুন ঋতু, এর ফলে বদলে গেছে তার রূপ। বাঙলা সাহিত্যের প্রথম বইটির নাম হলো চর্যাপদ। এর কবিতাগুলো ছোটো ছোটো, কবিদের মনের কথা এগুলোতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু এর পরেই দেখা দেয় বড়ো বড়ো বই, বিরাট বিরাট তাঁদের গল্প, এবং কবিরাও মনের কথা বলছেন না, বলছেন মানুষ ও দেবতার গল্প। এর পরে আবার আসে ছোটো ছোটা কবিতা, এগুলোকে আমরা বলি বৈষ্ণব পদাবলি। এগুলোতে প্রবল আবেগ আর মনের কথা বড়ো হয়ে ওঠে। এভাবে সাহিত্য বদলায়। কবিরা চিরকাল একই বাঁশি বাজান না। প্রতিটি নতুন সময় তাঁদের হাতে তুলে দেয় নতুন বাঁশরী।