- বইয়ের নামঃ রংধনুর সাঁকো
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ ছড়াসমগ্র
অন্তর সোনা
অন্তর সোনা যন্তর হাতে
ঘোরে বারান্দায়।
দুপায়ে তার চরকি বাঁধা,
ঘরে রাখাই দায়।
অন্তর যাদু ভাত খাবে না,
ডাল খাবে না মোটে।
খুশিতে খুব নেবে লুফে
মিষ্টি যদি জোটে।
অন্তর সোনা ফুস-মন্তরে
দত্যি-দানো তাড়ায়।
এক দৌড়ে অলিম্পিকে
দৌড়বাজদের হারায়।
অন্তর যাদু বীর সে বটে,
কার চেয়ে সে কম বা।
থাকবে না আর ছোট্র হয়ে,
আজই হবে লম্বা।
উলটো
নদীর কথা বলতে গিয়ে
গাছের কথা বলি।
সদর রাস্তা খুঁজতে গিয়ে
দেখি কানা গলি।
অন্ধকারে আলো দিতে
জোনাক হয়ে জ্বলি।
সহজ পথে চলতে গিয়ে
কঠিন পথে চলি।
উৎপাত
হায়রে ধেড়ে ইঁদুর সব
কেটে কুটে করল সাফ।
বাপরে বাপ!
শাড়ি চাদর পাজামা আর
বাহারি কোট ছারখার।
ডিকশনারি, লেখার খাতা
হচ্ছে রোজই ফাতা ফাতা।
সারাদিন সারারাত
ইঁদুরের উৎপাত।
ইচ্ছে করে মনের দুখে
নদীতে দিই ঝাঁপ।
মাফ চাই মাফ।
হায়রে চতুর ইঁদুর সব
কেটে কুটে করল সাফ,
বাপরে বাপ!
উড়ির চর
ভালো ওদের লাগত জানি
খোলা আকাশ, হাওয়ার পরীর নাচ।
লাগত ভালো ছোট্র পাখির
ডাকাডাকি, সবুজ পাতার গাছ।
ওদের খোকা খুমুকণি
রোজ বানাত কত্ত বালুর ঘর।
হাওয়ায় ভরা ফসলজোড়া
জায়গাটাকে বলে উড়ির চর।
হঠাৎ রাতে কালো পাখার
ঝাপটা মারে সুলেমানের দেও।
উড়ির চরে আছড়ে পড়ে
অজগরের মতোই হাজার ঢেউ।
ঘর উড়ে যায়, দোর উড়ে যায়,
পানির তলায় ডোবে দূরের দ্বীপ।
কেয়ামতের আঁধার যেন
নামল এসে, কেউ জ্বালে না দীপ।
কোথায় গেল ধানভানা দিন?
কোথায় গেল কিস্সা-বলা রাত?
বুকের মানিক ঘুমায় এখন
পানির তলে, এ কোন তেলেসমাত?
পাখপাখালি ডাকে না আর,
কেউ শোনে না বাঁশি উড়ির চরে।
সাঁঝবেলাতে চাঁদকপালি
গোরুর বাছুর ফেরে না আর ঘরে।
আকাশ কাঁদে, পাতাল কাঁদে,
বাতাস কাঁদে, কাঁদে মাঠের ঘাস।
কোথাও কারো নেই যে সাড়া-
এখন শুধু লাশের পরে লাশ।
চিল শকুনের আওয়াজ আসে,
ফুঁসছে শুধু সাগরপারের ঢেউ।
দিনদুপুরে, রাতদুপুরে
উড়ির চরে রইল না আর কেউ।
এমনিভাবে
সকালবেলা
চড়ুই শালিক খেলে কেমন মজার খেলা।
দুপুর হলে
মেঘনা নদীর জলে লক্ষ হীরে জ্বলে।
বিকেল এলে
সূর্যিমামা ক্লান্ত হয়ে যায় যে হেলে।
সাঁঝের কালে
মিনুর পিসি তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালে।
রাত্রি আসে,
দূর আকাশে দুধের রঙের চন্দ্র হাসে।
এমনিভাবে
সকল সময় দিনের পর রাত্রি যাবে।
খেলাঘরে
রাতদুপুরে একটি হরিণ হ্রদের ধারে আসে,
জ্যোৎস্না দিয়ে তৈরি পরী পা রেখেছে ঘাসে।
হাওয়ার দোলায় দুলে ওঠে কনকচাঁপার পাতা,
তাই-না দেখে ছড়ার ছন্দে হরিণ নাড়ে মাথা।
হ্রদের পানি খাচ্ছে চুমো পরীর শাদা পায়ে,
কে যেন ঐ আসছে দ্যাখো চ’ড়ে চাঁদের নায়ে।
চাঁদের নায়ে হাল ধরেছে ছোট্র খোকন সোনা,
ফুলে-ওঠা পালটা বটে তারা দিয়ে বোনা।
পাতার আড়াল থেকে হঠাৎ কোকিল ওঠে ডেকে,
সুরের ধ্বনি পরীর মুখে আবীর দিল মেখে।
রাতদুপুরে কোথায় বাজে আদ্যিকালের ঘড়ি?
চমকে তাকায় এদিক ওদিক হরিণ এবং পরী।
মনে আমার রইল গাঁথা রাতদুপুরের ছবি,
ভোরের আলোয় মিলিয়ে যাবে হরিণ পরী সবই।
রাজামণি স্বপ্ন থেকে উঠবে জেগে হেসে,
একটু পরে খেলাঘরে সবাই জুটবে এসে।
খোকার ইচ্ছে
বিকেলবেলা প্রজাপতির ওড়াউড়ি
দেখতে আমার ইচ্ছে হয়,
শীত-সকালে চুপটি ক’রে উনুনে হাত
সেঁকতে আমার ইচ্ছে হয়,
রাতের বেলা রুপোর বুটির মতো তারা
গুনতে আমার ইচ্ছে হয়,
ভেলায় ব’সে মেঘনা নদীর ভাটিয়ালি
শুনতে আমার ইচ্ছে নয়,
দুপুরবেলা মাঝপুকুরে সাঁতার কেটে
ভাসতে আমার ইচ্ছে হয়,
কাঠবিড়ালি এলে হঠাৎ খিলখিলিয়ে
হাসতে আমার ইচ্ছে হয়।
খোকার জন্যে
রাতদুপুরে কপাটে কে
আস্তে দিল কোটা?
বলতো আমায় চুপটি ক’রে
এলি কি তুই খোকা?
বাগান জুড়ে জুঁই চামেলি
ফুটছে থোকা থোকা।
এমন সময় কোথায় গেলি
লক্ষ্মী আমার খোকা?
ঘরের ভেতর আঁধার কাঁপে
বাইরে জোনাকপোকা।
আড়ালে আর থাকিসনে তুই
আয় চলে আয় খোকা।
রাগ করেছি ভেবে কি তুই
আসিস না আর খোকা?
কী করে বল ভাবলি এমন,
তুইতো ভারি বোকা!
শব্দ শুনি হরেক রকম,
খাচ্ছি শুধু ধোঁকা;
সবকিছুতে পায়ের শব্দ
পাচ্ছিরে তো খোকা।
কত নিশুত রাত গেল যে
নেইকো লেখাজোখা,
তবু আমার খাঁখা-বুকে
এলি না তুই খোকা।
ঘোড়ার গাড়ি
ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি
যাচ্ছ কোথায় তাড়াতাড়ি?
আহা তোমার দুটি ঘোড়া
যেন পক্ষিরাজের জোড়া।
করছে কারা মারামারি?
কাছেই আছে পুলিশ ফাঁড়ি।
লোকের মাথায় লাঠির বাড়ি,
পুলিশ পালায় জায়গা ছাড়ি’।
ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি,
ছুটছ কোথায় তাড়াতাড়ি?
গাড়োয়ানের সঙ্গে আড়ি,
কী ক’রে পথ দেবে পাড়ি?
জাদুকর
এইতো আমার ছোট্র নিঝুম ঘরে
দুপুরবেলায় চাঁদের পাপড়ি ঝরে।
আঁধাররাতেই হঠাৎ সূর্য ওঠে,
চোখের পাতায় আকাশ-কুসুম ফোটে।
চেয়ে দেখি একী আমার ঘরের পাশে
রঙিন পালের ময়ূরপঙ্খি আসে।
সেতারের সুরে পৌষের কুয়াশায়
গলির গাছটি নীল পরী হয়ে যায়।
দেয়ালে ঝোলানো পুতুলের গোল মাথা
রাজহংসের চষ্ণুতে আছে গাঁথা।
দরজায় এসে কড়া নাড়ে এক ছায়া,
ঝুলে থাকে রাতে পাষাণপুরীর মায়া।
খোকা ব’সে ভাবে, বাবার লেখার খাতা
কী ক’রে হয়েছে মায়াবৃক্ষের পাতা?
কী যে মজা হয় এ সরু গলিটা যদি
হয়ে যায় আজ খোকার গ্রামের নদী।
ভাবতেই গলি হ’ল নদী লহমায়,
এখানে কত যে জলপরী সাঁতরায়।
ঝুল-বারান্দা হীরে দিয়ে যেন গড়া
শূন্যে ভাসছে খুকির সোনার ঘড়া।
কবিতার বই কী যেন কিসের ঘোরে
অচিন পাখির মতো ঘরময় ওড়ে।
লেখার টেবিল ঝলমলে সরোবর
মনের খেয়ালে বানাল কে জাদুকর?