- বইয়ের নামঃ ধান ভানলে কুঁরো দেব
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ সাহিত্য বিলাস
- বিভাগসমূহঃ ছড়াসমগ্র
আতা গাছে, ডালিম গাছে
আতা গাছে চারটি পাখি,
ডালিম গাছে তিন-
সাতটি পাখি মনের সুখে নাচে তা’ধিন ধিন।
সাতটি পাখি সাতটি সুরে গান গেয়ে যায় রোজ,
আতা গাছে, ডালিম গাছে সুরের সে কি ভোজ।
হুকুম এলো একই সুরে গাইতে হবে গান,
নইলে জেনো সাতটি পাখির যাবে যে গর্দান।
শুনলো সবাই গাছতলাতে বাপরে সে কী হাঁক,
পড়লো ঢাকা সাতটি পাখির মিষ্টি সুরের ডাক।
কৈ পালালো গানের পাখি শূন্য ক’রে শাখ?
আতা গাছে, ডালিম গাছে বসছে শুধু কাক!
আরশোলা
আরশোলা রে আরশোলা
দেখে আমার দ্বার খোলা
উড়ে এসে বসলি জুড়ে
চার দেয়ালে কাছে দূরে,
বসলি এসে ঝাঁকে ঝাঁকে
আলমারিতে বইয়ের তাকে।
করলি ঘরের পাড় ঘোলা,
আরশোলা রে আরশোলা।
আরশোলা রে আরশোলা
খাবি কি গুড় চার তোলা?
ঘটিবাটি ময়দা আটা,
হাওয়াই জামা চিমটে ঝাঁটা
রঙের বাক্স, জমার খাতা,
ডিক্সনারির শ’য়েক পাতা,
চেটেপুটে করলি সাবাড়,
যা ছিলো সব হলো কাবার।
এবার ব’সে ঘাড় দোলা,
আরশোলা রে আরশোলা।
আয়না
সুমির মুখে বায়না শুধু বায়না,
মেলা থেকে আনতে হবে আয়না।
আয়না ছাড়া আর কিছু সে চায় না।
হঠাৎ সেদিন পাঁচ বছরের কন্যা
দোরের গোড়ায় দেখতে পেল বন্যা।
শুকনো মাটি কোথাও খুঁজে পায় না-
এক নিমেষে দেশটা হলো আয়না।
কবি
সেই ছেলেটা জান্লা থেকে দেখতো চেয়ে
পুকুর ঘাটে বটের ঝুরি।
দেখতো চেয়ে জলের ঘড়া, চিলের ওড়া-
কখনো ফের ইল্শে গুঁড়ি।
সবাই যখন থাকতো শুয়ে রাত দুপুরে
জড়িয়ে গায়ে ঘুমের কাঁথা,
সেই ছেলেটা একলা ব’সে শুনতে শুধু
আঁধার ঘরে তারার গাথা।
সেই ছেলেটা রাতের শেষে দেখত শাদা
রাস্তা যেন চুলের ফিতা।
পুব আকাশে সূর্য এলে বলতো হেসে,
“এইতো এলো আমার মিতা”।
আর সকলে পড়ার ঘরে দুলতো যখন
ধারাপাতের সুরে সুরে,
শুনতো সে-যে ছুটির রাখাল কোথায় যেন
বাজায় বাঁশি বহু দূরে।
শুনতো আরো নানান ধ্বনি, অচিন ঘাটে
শুনতো খেয়া-মাঝির গলা।
লেপের গুহায় শুনতো একা স্বপ্ন-নদীর
নিঝুম বুকে না’য়ের চলা।
পেন্সিলেরই রেখার মতো বৃষ্টি এলে
ঝম্ঝমিয়ে কালো ঘরে,
শুনতো সে-তো সারাবেলা মনের ঘাটে
জল পড়ে আর পাতা নড়ে।
মেঘ-মেঘালি, পাখ-পাখালি বলতো তাকে,
বর্ষা তাকে বলতো “রবি,
ঠাকুর বাড়ির ছেলে তোমায় বলুক লোকে
সবার তুমি আপন কবি”।
খেল
হাতী নাচছে ঘোড়া নাচছে
কদমতলায় কে?
সিংহ বলে, আমায় তোরা
খ্যাংড়া কাঠি দেয়।
হাতী নাচছে ঘোড়া নাচছে,
ভালুক নাচে রে।
সেই না নাচন দেখে ঈগল
বিষম হাঁচেরে।
ড্রাগন সোনা ঝাঁঝর বাজায়
পাঁজর দুলিয়ে।
কাগা বগা বাজায় শানাই
গালটি ফুলিয়ে।
ছবি আঁকিয়ে
আমার রঙের বাক্স থেকে
ঢালবো এমন নীল,
আকাশ পাতাল খুঁজলে তবু
পাবে না তার মিল।
আমার তুলির ছোঁয়ায় শাদা
পাতায় পড়বে দাগ।
হরিণ যাকে ভয় পাবে না
গড়বো তেমন বাঘ।
রঙের ছোপে উঠবে হেসে
পাথরকাটা পথ,
চিলেকোঠায় থামবে এসে
সূয্যিমামার রথ।
মেঝের চকে আঁকতে পারি
আকাশ-ছোঁয়া ঘর,
দেয়াল জুড়ে ভলগা নদী
কিংবা শুকনো থর।
ছাদে ওঠে ঝলমলিয়ে
সোঁদরবনের গাছ,
আঁচড় কেটে ধরতে পারি
সবুজ পরীর নাচ।
আমার রঙের খেলা এমন
রাতকে করে দিন।
খাতার কোণায় ঝলসে ওঠে
কঙ্গো কিংবা চীন।
ছেলেবেলা
ছোট্র আমার ছেলেবেলা,
লক্ষ্মী আমার ছেলেবেলা,-
তুকি কি ভাই হীরের ফল?
কিরণমালার পায়ের মল?
তুমি কি লাল পরীর কেউ?
ক্ষীর-সাগরে উতল ঢেউ?
চলন বিলে দুপুরবেলা
তুমি কি ভাই ছোট্র ভেলা?
ছোট্র আমার ছেলেবেলা,
লক্ষ্মী আমার ছেলেবেলা!
তুমি কি ভাই দাদুর শাল?
হীরামনের ঠোঁটের লাল?
তুমি কি নীল পাখির ডাক?
জ্যোছ্না-মাখা গাছের ফাঁক?
স্বপ্ন-ঢাকা রাতের বেলা
তুমি কি ভাই মজার খেলা?
ছোট্র আমার ছেলেবেলা,
লক্ষ্মী আমার ছেলেবেলা!
ছড়ার দেশে
ছড়ার দেশে ছবির খেলা,
রঙের মেলা আকাশে।
পরীর মেয়ে ওড়না ওড়ায়
হাল্কা মিহি বাতাসে।
পদ্মদীঘির কালো জলে
কতো না ফুল ফুটেছে।
চাঁদের মুখে ঝুমকো লতা
জ্যোছ্না বেয়ে উঠেছে।
টুকটুকে রঙ গালে মেখে
সকাল আসে রোজানা।
সন্ধ্যা আসে ঘোমটা মুখে
চোখ দুটো কি বোজা না?
আমের ডালে মুকুল দোলে,
ঘোড়া দোলে ঢোলকে।
রোদের গুঁড়ো ঝলসে ওঠে
চম্পাবতীর নোলকে।
নদীর বালি ঝুরঝুরনি,
পানি গোলা আবীরে।
সুয্যি মামার বিয়ে হবে,
সঙ্গে তোরা যাবিরে।
বরের গায়ে হলুদ দিলো
কমলা পুলির টিয়েটা।
ঢোলক নিয়ে ঢুলি এলো,
হ’য়ে গেল বিয়েটা।
ঝড়ের মুখে
নদীর তীরে আকাশ ফুঁড়ে
লক্ষ কোটি হায়না কাঁদে-
বুক হ’ল জর্জর
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
রাত দুপুরে কোন্ খেয়ালে
এক পলকে উড়িয়ে বলো
কে নিয়েছে ঘর?
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
আকাশটাকে ভাঙছে কারা?
ভাঙছে বাড়ি সারি সারি,
যেন বালির ঘর।
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
চাল নিলো, চুলো নিলো
ঘটি, বাটি সবই নিলো,
নিলো কাঠের গড়।
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
ধান নিয়েছে, জান নিয়েছে,
চাষীভায়ের হাল নিয়েছে,
রইলো পড়ে চর।
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
গোয়ালঘরের নেই ঠিকানা,
নেইকো গরু, নেইকো বাছুর,
নেই বিচালি খড়।
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
ভাসছে জলে ময়না, টিয়ে,
কাকের ছানা, বকের ডানা,
ভাসছে কবুতর।
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
একলা পথে ঘরের বধূ
কপাল ঠুকে রইলো পড়ে-
কোথায় গেলো বর?
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
জেলের সরু নৌকাগুলো
ডুবলো হঠাৎ স্রোতের টানে,
ডুবল মধুকর।
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
ঘরে ঘরে কান্না জাগে,
মৃত্যু শুধু বেড়ায় ঘুরে,
অচিন সদাগর।
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
ঘূর্ণিহাওয়ায় হারিয়ে গেলো,
এক নিমেষে হাতেম গেলো,
গেলো লখিন্দর!
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!
ক্ষেপে-ওঠা নদীর ধারে
মরা মোষের পিঠের’ পরে
শিশুর কচি ধড়।
ঝড়, ঝড়, ঝড়,
সর্বনাশা ঝড়!