- বইয়ের নামঃ আমের কুঁড়ি, জামের কুঁড়ি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ ছড়াসমগ্র
অচিন ঘোড়সওয়ার
পেরিয়ে সবুজ পরীদের ঘাট,
পেরিয়ে অনেক জ্যোৎস্নার মাঠ
এল নির্জন বাড়িটার কাছে
অচিন ঘোড়সওয়ার।
আঁধারে জ্বলছে পাগড়ির চুড়ো,
ঘোড়ার শরীর তারাদের গুঁড়ো
বন্ধ কপাটে বল্লম ঠোকে
অচিন ঘোড়সওয়ার।
বলে না কিছুই, কাউকে ডাকে না,
এখানে তা হলে কেউ কি থাকে না?
বাড়িটাকে ঘিরে ঘোরে একা একা
অচিন ঘোড়সওয়ার।
চিকচিকে ঘাম ঘোড়ার শরীরে,
নিশ্বাস কাঁপে জোনাকির ভিড়ে,
ঘাড়ফোলা পেঁচা দ্যাখে কী যে একা
অচিন ঘোড়সওয়ার।
ভুখা চাঁদ ক্রমে হেলে পড়ে কোণে,
ঘোড়ার খুরের ধ্বনি ডোবে বনে,
ঘাসগুলি দ’লে চলে যায় দূরে
অচিন ঘোড়সওয়ার।
অচিন ফুল
ফুরফুরে এই ফটিক হাওয়ায়
উড়ছে উড়ুক চুল,
ফুটফুটে সব ফুটপাতে আজ
ফুটুক অচিন ফু্ল।
আমার কলম
আমার পিঁড়ি নৌকা হয়ে
ক্ষীর নদীতে ভাসে।
জামবাটিটা চাঁদের মতো
নীল আকাশে হাসে।
আমার টেবিল হঠাৎ করে
বাগান হয়ে যায়।
সেই বাগানে সোনার পাখি
হীরার ফল খায়।
আমার ছোট বিছানাটা
রত্নদ্বীপের মতো
সেই দ্বীপেতে নেচে বেড়ায়
পরী শত শত।
আমার খাতা ঈগল পাখি,
পাহাড়চূড়ায় থাকে,
চায় না সে তো থাকতে জানি
ছোট্র পাখির ঝাঁকে।
আমার দোয়াত সাঁতার কাটে
নিঝুম সরোবরে;
আমার কলম অস্ত্র হয়ে
দুষ্ট দমন করে।
আমার খাতা
আমার খাতা অবাক করা
তেলেসমাতি খাতা,
চমকে তুমি উঠবে জানি
দেখে হরেক পাতা।
আমার খাতায় জড়িয়ে আছে
সবুজ পরীর মায়া,
তাই সেখানে খেলা করে
পাষাণপুরীর ছায়া।
আমার খাতায় দোলে হাওয়ায়
হীরের গাছের ফল,
বাজে মধুর চম্পাবতীর
পায়ে সোনার মল।
আমার খাতায় আছড়ে পড়ে
সাত সাগরের ঢেউ,
আকাশ কালো করে আসে
সুলেমানের দেও।
আমার খাতায় সিন্দাবাদের
জাহাজ বেড়ায় ভেসে,
আকাশ-ছেঁড়া তারা ঝরে
কঙ্কাবতীর কেশে।
আমার খাতায় ডালিম কুমার
পক্ষীরাজে ওড়ে,
পক্ষীরাজের পালক পড়ে
দুয়োরানির দোরে।
আমার খাতায় রবি ঠাকুর
হাসেন রবির মতো।
কাজী কবি ঝড় হয়ে যান,
দোলেন অবিরত।
আমার খাতায় বানায় বাসা
বাবুই পাখি সুখে,
সুর ঝরিয়ে দেয় পাপিয়া
উইয়ের ঢিঁবির বুকে।
আমার খাতায় ডুকরে ওঠে
লক্ষ ভুখা লোক,
তাকিয়ে থাকে হিরোশিমার
গলে যাওয়া চোখ।
আমার খাতায় গর্জে ওঠে
ভীষণ মেশিনগান,
আমার খাতায় মিশে থাকে
ভোরের পাখির গান।
আমার খাতায় স্বাধীনতার
নিশান আছে আঁকা
আমার খাতা জুড়ে শাদা
কবুতরের পাখা।
আমের কুঁড়ি, জামের কুঁড়ি
আমের কুঁড়ি, জামের কুঁড়ি
পড়ছে ঝরে ভুঁয়ে।
তেঁতুল গাছে চালতা বাদুড়,
ডালটা আসে নুয়ে।
ঝির ঝির ঝির হাওয়া চলে
বটের ঝুরি ছুঁয়ে।
বটতলাতে দুটি বাঁদর,
ঝগড়া বাঁধে দুয়ে।
চাঁদের বুড়ি মুখটি রাখে
জ্যোৎস্না দিয়ে ধুয়ে।
কে নেভাল ঘিয়ের বাতি
ইয়া বড় ফুঁয়ে?
দেখছো নাকি একলা ঘরে
খোকন আছে শুয়ে!
ইঁদুর কাটে
ইঁদুর কাটে চাদর-বালিশ
কাটে শাড়ির খুঁট,
কাটে ওরা ঘরের বেড়া
কুটুর কুটুর কুট।
ধেড়ে ইঁদুর দেখে বিড়াল
দিচ্ছে দূরে ছুট;
চোরের দাপট বাড়ছে ক্রমে
পুলিশ পালায় হুট।
শহর-গ্রামে দিনদুপুরে
চলছে হরির লুট,
গোল করো না, নইলে পাড়ার
স্বপ্ন যাবে টুট।
রাতদুপুরে মচমচিয়ে
ওঠে হাজার বুট;
সত্য গেছে বনবাসে
রাজ্যি চালায় ঝুট!
উল্টো সুর
রোদের রেণু, চাঁদের আলো
চাই নে কিছুই চাই নে।
আঁধার ছাড়া কোনো কিছুই
নেইকো বাঁয়ে-ডাইনে।
ফুলের গন্ধ, ছড়ার ছন্দ
চাই নে কিছুই চাই নে,
বলছে কারা নাকি সুরে
‘মাটির তলায় ঠাঁই নে’।
গুণিজনের বিদ্যেবুদ্ধি
চাই নে পেতে চাই নে,
দাঁড়াই হেসে আমরা সবাই
মুরুক্ষুদের লাইনে।
পাতকুয়োতে বেশ তো আছি
অন্যকোথাও যাই নে
ময়ূরপঙ্খি নায়ে চেপে
সমুদ্দুরে বাই নে।
গায়ের কাপড় মুখের অন্ন
চাই নে কিছুই চাই নে,
বাদ দিয়েছি সব কিছু ভাই
যাচ্ছেতায়ের আইনে।
এক যে ছিল টিয়ে
এক যে ছিল কেমন টিয়ে
দেখত, কিছু বলত না।
তাকে ছাড়া শেবামণির
এক নিমেষও চলত না।
একটু আমায় বলবে তুমি
কোথায় টিয়ের জন্মভূমি,
সেই দেশে কি হীরার গাছে
একটি ফলও ফলত না?
সেই টিয়েটা দেখত কত
পাখপাখালি ফুলের গাছ,
দেখত কত হাতি ঘোড়া,
দেখত মজার পুতুলনাচ।
পণ করেছে লক্ষ্মী টিয়ে
থাকবে মুখে গিলটি দিয়ে।
তাই তো শেবার ছোট্র ঘরে
ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলত না।
খুশি, হঠাৎ খুশি
খুশি, হঠাৎ খুশি
তুই কি আমার পুষি?
চড়ে সোনার রথে
স্বপ্নপুরীর পথে
আসিস কি তুই ওরে
হঠাৎ আমার দোরে?
খুশি, হঠাৎ খুশি
তুই কি আমার পুষি?
দিনটা যখন ডাকে,
কাজলা মেঘের ফাঁকে
তুই কি রোদের উঁকি?
তুই কি সূর্যমুখী?
দুউপুর যখন চড়া,
কানায় কানায় ভরা
কালো দিঘির জলে
পদ্মপাতার তলে,
তুই কি মাছের নড়া?
এই শহরে তোকে
পাচ্ছে পাড়ার লোকে।
সবখানে তোর সাড়া;
উঠছে মেতে পাড়া।
ভাঙা ইটের ফাঁকে
তুই কি সবুজ চারা?
সে সুর ঝরে ঝুনঝুনিয়ে
ঝাঁঝাঁ দুপুর বেলায়,
মৌমাছিদের মেলায়।
সে সুর এল মাঠে পেরিয়ে
হাট পেরিয়ে
ঘাট পেরিয়ে
বালিহাঁসের পাট এড়িয়ে
হঠাৎ এল পথ ভুলে কি
প্রিয় আমার শহরে?
আনাগোনার প্রহরে?
সে সুর ওড়ে ফুরফুরিয়ে
সে সুর ঝরে ঝুরঝুরিয়ে
মস্ত বড় বাড়িতে
রিকশা, মোটরগাড়িতে।
সে সুর ঝরে পথের ধারে
ব্যস্ত মুদির চালায়,
নোংরা গলির নালায়।
ট্রাফিক আলোর হুকুম চেখে,
পথে-ঘাটে পুলিশ দেখে
থমকে দাঁড়ায় একলা,
মুখ হলো তার মেঘলা।
একটু পরে সামলে নিয়ে
বেচারামের দেউড়ি গিয়ে
সে সুর ওড়ে ফুরফুরিয়ে,
সে সুর ঝরঝুরিয়ে
দিন মজুরের খুপরিতে,
উপুড়-করা চুপড়িতে।
সেই যে সকাল হতে
শান-বাঁধানো পথে
মানুষগুলো চলে
পুতুলনাচের ছলে।
অজানা এক ঝোঁকে
ইটের গুহায় ঢোকে।
সেখানে সব ঢুকে
মাথায় মাথা ঠুকে
কাশে এবং হাঁচে,
এমনি করেই বাঁচে।
হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে
পক্ষী আসে উড়ে।
সোনার জলে ভিজে
পক্ষী বলে কী-যে।
পাখির মধুর সুরে
কাছে এবং দূরে
সত্যি সবার আগে
চম্পা পারুল জাগে।
খুশি, হঠাৎ খুশি,
তুই কি আমার পুষি?
রাখব তোকে বুকে,
চোখের তারায়, মুখে।
আমার কাছে এলে
রৌদ্রে দেব মেলে।
রাত্রে তোকে পেলে
জ্যোৎস্না দেব ঢেলে।
দুপুর হলে খাঁ খাঁ,
করব তোকে পাখা।
শীতে হলে কাবু
বানিয়ে দেব তাঁবু।
দত্যিদানোর হাঁকে,
হুতুম পেঁচার ডাকে
ডাইনি বুড়ির শাপে
বুক যদি তোর কাঁপে,
ধরব তোকে বুকে,
থাকবি শান্ত সুখে।
বল তো তোকে খুশি
কেমন করে পুষি?