- বইয়ের নামঃ মানব হৃদয়ে নৈবদ্য সাজাই
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অথচ কারবালা
এখানে কোথাও শরজর্জরিত দুলদুল নেই,
ফোরাতের কুলু কুলু ধ্বনি নেই, নেই কাশেমের
লাশ নিয়ে নতুন মেহেদি রাঙা হাতে মুখ ঢেকে
বিবি সখিনার বুকফাটা করুণ বিলাপ, তবু
রাজধানী শহরের অলি গলি, জীর্ণ বস্তি, প্রায়
সর্বত্র কেবলি, ধূ ধূ কারবালা। হাহাকার ওঠে
ঘরে ঘরে; চতুর্দিকে শূন্য কলস, বালতি, ঘড়া।
কারো কারো চোখে মরুভূমি, মরীচিকা, আর্ত তাঁবু,
ফোরাতের রক্তাপ্লুত তীর জেগে ওঠে আর
‘পানি দাও, পানি দাও’ আওয়াজে বাতাস ভারী হয়
প্রহরে প্রহরে। এই যাঞ্চা রবীন্দ্রনাথের বৌদ্ধ
ভিক্ষু আনন্দের ‘জল দাও’ নয়, বিপুল গোষ্ঠীর
আর্তনাদ জলসত্র লক্ষ ক’রে কোন্ চন্ডালিকা
ঘড়াভরা জল দেবে এনে শত শত পিপাসার্ত
মানুষের আঁজলায়? চৈত্রের দুপুরে যারা আজ
বিশুষ্ক, অপেক্ষমান, তারা কি করবে পান এই
নর্দমার কালো পানি পথচারী পশুদের মতো?
বস্তুত নগরবাসী কারবালা প্রান্তরে দাঁড়ানো!
অনিশ্চয়তার প্রান্তরে
সূর্য পাকা ফলের মতো টুপ ক’রে পড়ল
দিগন্তের ওপারে। অন্ধকারের জিভ
লেহন করছে পৃথিবীকে। তোমাকে দেখলাম দাঁড়ানো
এক বিশাল প্রান্তরে হু হু হাওয়ার মধ্যে।
তোমার খোঁপার বেলফুলগুলো দূরের আকাশের তারা,
হাওয়ার তোড়ে শাড়ি
আরো বেশি লেপ্টে যাচ্ছিলো শরীরে। মনে হ’লো,
তুমি তাকিয়ে আছো অনন্তের দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে।
সেই মুহূর্তে তোমার মুখ চুম্বন করতে পারতাম, অথচ
এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা আমাকে শাসন করছিলো
শুরু থেকেই; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
শুধু দেখছিলাম তোমাকে। উদ্দাম হাওয়া
নিস্তব্ধতা এবং নৈশ রাগিনী
আমাকে আমন্ত্রণ জানালো তোমার সৌন্দর্য পানের জন্যে।
রাত্রির পেয়ালা উপচে পড়েছিলো
মদিবার চেয়েও মদির এক পানীয় যা আমাকে
প্রতিশ্রুতি দেয় অমরতার। তুমি সরাইখানার দরজার
আড়ালে দাঁড়িয়ে বাড়ালে হাত। অকস্মাৎ একটি কালো
বেড়াল, যার চোখ দু’টো সবুজ, আমাকে ‘অবুঝ’ ব’লে
দিলো লাফ ধূ ধূ শূন্যতায়। তোমার চোখে ফসফরাসের আলো।
তুমি, আমি খোলা আকাশ,
নগ্ন সমুদ্রতীর, নানা রঙের নুড়ি, রাত্রির ঠোঁটে
কিসের ঝিলিক, কে এক কংকাল
আমার শরীর ঘেঁষে চলে যায়, তার ঠান্ডা নিঃশ্বাস
লেগে থাকে আমার গ্রীবায়। আমরা দু’জন,
তুমি আর আমি, পরস্পর হাত ধরে হাঁটতে থাকি
সামনের দিকে, পেছনে পড়ে থাকে
সরাইখানার নিস্তেজ আলো, মাতালদের
কোলাহল। সেই কর্কশ কম্বল-জড়ানো কংকাল
বাদুড়ের মতো উড়ে যায়। অনিশ্চয়তা
আলেয়া হয়ে হাতছানি দেয়, হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া
ধুলো ছুঁড়ে দেয় আমাদের চোখে, চাঁদ
আত্মহননের গান শোনায়, আমরা
একে অন্যকে আরো বেশি জড়িয়ে ধরি জন্ম-জন্মান্তরের আকর্ষণে।
৭/৫/৯৫
আমাকে এভাবে তুমি
আমাকে এভাবে তুমি বসিয়ে রেখো না প্রতীক্ষায়।
আমি কি বসেই থাকি? না, না, ঠিক নয়, উঠে পড়ি
মাঝে মাঝে, করি পায়চারি ঘরময়, বারান্দায়
যাই, পুনরায় ঘরে ফিরে আসি, দেয়ালের দিকে
চোখ রাখতেই টিকটিক দেখা যায়; হাতে নিই
কবিতার বই, রেখে দিই পাতা উল্টিয়ে আবার
চেয়ারে আশ্রয় খুঁজি, বসে থাকি দীর্ঘ প্রতীক্ষায়।
আমাকে এভাবে তুমি বসিয়ে রাখবে কতকাল?
যারা কারো পদধ্বনি, কণ্ঠস্বর শোনার আশায়
পথ চেয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ, কেবল তারাই জানে
প্রতীক্ষার দাঁত কত ধারালো, নিষ্ঠুর, বসে যায়
সহজেই অন্তর্গত মাংসের ভেতর, চোখ ফেটে
জল আসে, সেই জলে বর্তমান, ভাবীকাল ভাসে।
১৬/৪/৯৫
আমাকে বাঁচায়
নিউইয়র্কের নিঝুম এলাকা উডসাইডে ক’দিন
আছি স্বদেশের মুখ না দেখে; পাশেই
অনেক মার্কিন পরিবার। দেখাশোনা,
সুপ্রভাত ব’লে কোনো আলাপের রেণু
ওড়াবার অবকাশ নেই।
নিজের মধ্যেই আছি ডুবুরীর মতো।
কখনো স্বপ্নের জলমগ্ন লতা-গুল্ম ক্ষিপ্র মাছ, কারো স্মিত মুখ
সত্তা ছুঁয়ে যায়।
কেন এই পরবাসে শ্বেতাঙ্গ কি প্রবল কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের
অন্তরঙ্গ আসরে আমার নেই ঠাঁই? কেন আমি
বহিরাগতের চিহ্ন নিয়ে
ম্যানহ্যাটানের পথে হাঁটি,
সাবওয়ে পাড়ি দিই আলো আঁধারিতে? কেন কেউ
‘এসো ভাই’ ব’লে্
বসায় না পাশে? মৃদু হেসে
নিমেষে ওঠে না মেতে মধুর আলাপে? এরকম
নৈর্বক্তিক পরিবেশে কীভাবে নিঃশ্বাস নিই? এই বিচ্ছিন্নতা
কেবলি গুমরে ওঠে মনের ভেতর।
ফেরাই স্বদেশে মুখ ক্ষণে ক্ষণে, স্মৃতিসমুদয়
আমার হৃদয় ঘিরে রঙিন মাছের মতো কেলিপরায়ণ
ধানমন্ডি, শ্যামলী, মাহুৎটুলি, আওলাদ হোসেন লেনের
রূপ কী স্নেহার্দ্র ফুটে ওঠে
নিউইয়র্কের প্রেক্ষাপটে। ভালোবাসা
এমন হৃদয়হীনতায় আমাকে বাঁচায়।
নিউইয়র্ক, ৭ সেপ্টেম্বর ৯৫
আমার হৃদয়
সত্যি বলতে কী, কখনো একরত্তি ভয় পাইনি
কোনো স্বৈরাচারীর ভ্রূকুটি দেখে। এক ভিড় চাটুকার
আর পদলেহী পরিবেষ্টিত সমারূঢ় মহিলার আকাশ-ছোঁয়া
স্পর্ধা আমাকে হাসির খোরাক জুগিয়েছে।
সশস্ত্র মৌলবাদীদের মূর্খ উচ্ছ্বাসময় হুঙ্কার
বারবার তাচ্ছিল্য করেছি, সকল দুঃখ-দুর্দশা
আমার ঘাড় ধরে নুইয়ে
আমাকে ধুলো চাটাতে ব্যর্থ হয়েছে।
অথচ প্রিয়তমা, তোমাকে দেখতে না পাওয়ার
দীর্ঘ কষ্টে সর্বক্ষণ অন্ধ পাখির বিলাপ আমার হৃদয়।
নিউইয়র্ক, ৯ সেপ্টেম্বর ৯৫