- বইয়ের নামঃ ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ ঐতিহ্য
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে
আচমকা কুয়াশা-কাফন চকচকে দুপুরেই গিলে ফেলে
আমাকে চলিষ্ণু ভিড়ে। কয়েকটি হাত লুফে নেয়
আমার শরীর এক লহমায় পথের কিনার থেকে এবং ঠেলতে
শুরু করে কে জানে কোথায়। এ রকম আচানক ঘটনায়
ভীষণ বিব্রত, বলা যেতে পারে, বিপন্ন বোধের
দখলে আটকে পড়ি। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন দু’টি চোখ জ্বালা করে।
কতিপয় মুণ্ডহীন অস্পষ্ট শরীর বয়ে নিয়ে
চলেছে আমাকে কোথায় যে, বোঝা দায়। জীবিত কি
আমি, নাকি লাশ হয়ে আজব কবন্ধদের কাঁধে
শুয়ে যাচ্ছি লাশকাটা ঘরে? এখানে উত্তর দাতা কেউ নেই।
আমি কি দেখছি পথে আমারই রক্তের ফুলঝুরি
সত্য ভাষণের অপরাধে? হায়, বেলা অবেলায় ক্রুশবিদ্ধ
প্রাণহীন শরীর আমার দেখছে কি কৌতূহলী নরনারী?
কে এক সুকণ্ঠী শিল্পী গান গেয়ে আসর মাতাতে গিয়ে খুব
বেসুরো আওয়াজ তুলে মূক হয়ে যায়। একজন খ্যাতিমান চিত্রকর
সুসময় ফুটিয়ে তোলার রঙে দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে ফেলে।
পদে পদে ইচ্ছাকৃত ভ্রম ঘটে সমাজের বিভিন্ন সারিতে,
ফলত কান্নায় ভাসে অসহায় নরনারী। গোল টেবিলের
অট্রহাসি কনসার্ট হয়ে বাজে যখন তখন! আহা মরি!
অমূল্য কাগজে ঘন ঘন দস্তখত চলে নানা ছাঁদে আর
কুয়াশা-কাফন নামে, নামতেই থাকে জগতের
নানান অঞ্চলে। আমি কোথায় এখন? মার্গে? নাকি ধু ধু চরে?
১৭-০২-২০০২
আবুল হোসেন শ্রদ্ধাস্পদেষু
মনে পড়ে, সুদূরকালে এক সতেজ সকালে নাজিমুদ্দিন
রোডে বেতার ভবনে আমার সদ্য লেখা
কবিতা নিয়ে আপনার টেবিলের সামনে
দাঁড়িয়েছিলাম কবিতা পাঠের আমন্ত্রণে। আগেই
আপনার, আহসান হাবীব আর ফররুখ আহমদের
নানা কবিতার সঙ্গে ছিল পরিচয়।
কী করে ভুলব স্নেহময় সেই ডাক যা আমাকে
নিয়ে গিয়েছিল আজিমপুর কলোনির
ঝকঝকে ফ্ল্যাটে, যেখানে ছিল
আপনার জীবনযাত্রার আসর? হ্যাঁ, আপনার
আন্তরিক আমন্ত্রণ আমাকে বারবার
নিয়ে যেত বাইরে শান্ত, অন্তরে উদ্দাম
এক তরুণকে। সেই তরুণের শ্রদ্ধাঞ্জলি
উন্মীলিত ছিল আপনারই দিকে।
আজ এই সত্তর-পেরুনো আমার মনে
সেলুলয়েডে এক চিত্রমালা যেন
উদ্ভাসিত, দেখছি এক কামরায় আপনারা
কজন বন্ধু, প্রত্যেকেই মাঝবয়েসী-প্রায়, তাসের রাজা, রানী
আর গোলাম নিয়ে মশগুল আর এক তাজা তরুণ
অনুরুদ্ধ হয়ে আপনার পূর্ব-প্রকাশিত এলোমেলো ছড়ানো
অনেক কবিতা একটি পৃথুল খাতায় কপিরত নিবিষ্ট চিত্তে।
হঠাৎ স্তব্ধতা চিরে ডেকে উঠে দুপুরকে আরও বেশি
উদাস ক’রে তোলে আকাশে পাক-খাওয়া চিল। কলম থামিয়ে
জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে দেয় কবিতায়-পাওয়া সেই তরুণ।
শ্রদ্ধেয় করি, আপনি আজ এই আশি বছর বয়সে সেই
তরুণকে আবিষ্কার করতে পারবেন কি
এমন ভাঙাচোরা আমার ভেতরে, আপনার
আনন্দ, বেদনা, রোগ, শোক এবং
চলার পথে উদ্দীপনা, ক্লান্তি, পুরস্কৃত প্রহর, এমনকি
হতাশার অন্তত খানিক অংশীদার? আপনি কি বিশ্বাস করেন না
আমার এই প্রশ্নের ব্যাকুলতা? আপনি কি, হে আমার
অগ্রজ সার্থক কবি, মৃদু হেসে খারিজ করে দেবেন নিবেদিত এই কথামালা?
স্বজন-পরিবৃত, পুষ্পশোভিত ড্রইংরুমে মনে কি পড়বে না
সেই নিবেদিত-চিত্ত স্বপ্লভাষী, লাজুক,
স্বপ্ন-তাড়িত, কবিতা মাতাল তরুণের কথা?
১৩-০৮-২০০২
ইচ্ছেটাও মৃত
কে যেন ঠুকরে দিল খুব জোরে ঘুমন্ত আমাকে
আপাদ মস্তক। চোখ খুলতেই দেখি, একি পুবে ও পশ্চিমে,
উত্তর দক্ষিণে ভয়ঙ্কর দাঁত-নখ বের-করা অন্ধকার-
বসে আছে বিকট শকুন এক, যার
চঞ্চু থেকে ঝরছে শোণিত। ‘মানবতা
হয়েছে শিকার তার’, কারা যেন গলিপথে হেঁটে
যেতে-যেতে বলে গেল ভয়ার্ত গলায়। শয্যা ছেড়ে
উঠতে চেয়েও ব্যর্থ আমি, এক ফোঁটা আলো নেই কোনওখানে।
বহুদিন হ’ল শহরে ও গ্রামে, কোনওখানে কারও
ঠোঁটে হাসি নেই, এমনকি শিশুরাও হঠাৎ হাসতে ভুলে গেছে
যেন কোন্ অশুভ সংকেতে। আমি আজ
কলমের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুনি হাহাকার,
খাতার সফেদ পাতা কেঁপে ওঠে নিরন্ত ফোঁপানি এবং
শৃংখলিত কারও ঝাঁকুনিতে যেন। কে আজ সহায়?
এই হিংস্র অন্ধকারে, হে বিদ্রোহী কবি, আজকাল
আপনাকে বড় বেশি মনে
পড়ছে আমার ক্ষণে ক্ষণে, আপনি তো ঢের আগে
কারার লৌহকপাট তুমুল ভাঙার,
লোপাট করার আর জোর সে হ্যাঁচকা টানে
গারদগুলোকে, ওহো, প্রলয় দোলায়
দুলিয়ে কঠোব কুশাসন সমাপ্তির মন্ত্র জপিয়ে ছিলেন
দেশবাসীদের দিকে দিকে শহরে ও পাড়াগাঁয়।
এই বুনো তিমিরে আপনি কবি পুনরায় সূর্যের মতোই
চোখ মেলে বাবরি দুলিয়ে ঝোড়ো বেগে এই জ্যৈষ্ঠে চলে এলে
ভণ্ডদের ক্রূর খেলা হবে শেষ, পশ্চাতগামীর ভুয়ো জয়ঢাক
যাবে থেমে তিমির-বিনাশী প্রগতির
দীপ্ত সুরে। আমরা এখনও ব্যর্থতার
কাদায় আকণ্ঠ ডুবে আছি, হয়ে যাচ্ছি ক্রমে কাদার পুতুল!
শুভবাদী পুষ্পগুলি ঝরে যায় অতিশয় দ্রুত,
জানি আজ জাঁহাবাজ দানোদের পায়ের টোকায়
বিচূর্ণ, বিধ্বস্ত কত বিদ্যাপীঠ, বোবা
কান্নায় ত্রিলোক কম্পমান!
মূঢ়, মূর্খদের থুতু, বাচালতা তাড়িয়ে বেড়ায়
বস্তুত ধীমানদের সর্বক্ষণ, পথে ও বিপথে
পড়ে থাকে লাশ, শুধু লাশ। কারও দিকে
কারও তাকাবার ইচ্ছেটাও মৃত।
১৭-০৫-২০০২