- বইয়ের নামঃ বন্দী শিবির থেকে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আন্তিগোনে
শহর-মরু বিজন বড়,
নীরব তো সব গায়ক পাখি।
আন্তিগোনে, আন্তিগোনে
রুক্ষ পথে ব্যাকুল ডাকি।
প্রেত নগরী নগ্ন, ফাঁকা,
নেই যে ভালো একটি প্রাণী।
দরদালানে, রাস্তা ঘাটে
ভাসছে শুধু মৃতের ঘ্রাণই।
আন্তিগোনে নামেই যেন
একলা চলার করুণ পথ।
আন্তিগোনে তুমিই জানি
বস্তু-ছেঁড়া নীল শপথ।
সান্ত্রী-সেপাই দিক পাহারা,
নগর-জোড়া থাক না ত্রাস।
তোমায় তবু শংকা কোনো
পারেনিকো করতে গ্রাস।
প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে
খুঁড়লে মাটি ক্ষিপ্র হাতে,
সোদর তোমার তাই তো পেল
ক্ষণিক কবর ভুল প্রভাতে।
কোন সাহসে হেলায় তুমি
উড়িয়ে দিলে রাজার বিধান?
কিসের টানে রুদ্ধ গুহায়
আনলে টেনে দারুণ নিদান?
জানতে ক্রূর ক্রেয়োন তোমার
একনায়কী দণ্ড দেবে,
মৃত্যুপুরে দেবে ঠেলে-
দেখলে না তো একটু ভেবে।
সহোদরের ছিন্ন শরীর
করলে আড়াল সংগোপনে।
সৎকার সে তো উপলক্ষ,
অন্য কিছু ছিল মনে।
আন্তিগোনে দ্যাখো চেয়ে-
একটি দুটি নয়কো মোটে,
হাজার হাজার মৃতদেহ
পথের ধুলায় ভীষণ লোটে।
রৌদ্রে শুকার রক্তধারা,
মাংস ছেঁড়ে শবাহারী,
কে দেবে গোর দুর্বিপাকে?
নেই যে তুমি উদার নারী।
আমাদের মৃত্যু আসে
আমাদের মৃত্যু আসে ঝোপে ঝাড়ে নদী নালা খালে
আমাদের মৃত্যু আসে কন্দরে কন্দরে
আমাদের মৃত্যু আসে পাট ক্ষেতে আলে
গ্রামে গঞ্জে শহরের বন্দরে
আমাদের মৃত্যু আসে মাঠে
পথে ঘাটে ঘরে
আমাদের মৃত্যু আসে হাটে
সুডৌল ট্রাফিক আইল্যান্ডে ধু-ধু চরে
আমাদের মৃত্যু আসে কাদায় মাটিতে
আমাদের মৃত্যু আসে ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে
পরিখায় বিবরে ঘাঁটিতে
আমাদের মৃত্যু আস বরিশাল, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, ঢাকায়
আমাদের মৃত্যু আসে কুমিল্লা, সিলেট, চাটগাঁয়
আমাদের মৃত্যু আসে প্লেনে চেপে, জাহাজ বোঝাই করে আসে
আমাদের মৃত্যু আসে সুপরিকল্পিত নকশারূপে
আমাদের মৃত্যু আসে ইসলামাবাদ থেকে
আমাদের মৃত্যু আসে কারবাইনে বারুদের স্তূপে
আমাদের মৃত্যু বিউগলে যায় ডেকে
আমারও সৈনিক ছিল
আমারও সৈনিক ছিল কিছু-
মাথায় লোহার টুপি, সবুজ ইউনিফরম পরা,
হাতে রাইফেল। শৈশবের বারান্দায় নিরিবিলি
কল টিপে দম
দিলেই চকিতে ওরা কুচ-
কাওয়াজে উঠত মেতে। কি নিরীহ ভঙ্গি-
মুখে হাসি আঁটা। থেমে যেত
দম ফুরুলেই। আমি বড়
ভালোবাসতাম শৈশবের
সেই সৈন্যদের।
একদা হঠাৎ
আমার অনুজ
একটি সৈন্যের ঘাড় ভেঙে ফেলেছিল বলে আমি
তার সঙ্গে তিন
আড়ি দিয়েছিলাম আজও তা মনে পড়ে।
আমার সুদূর শৈশবের
ক্ষুদে সৈনিকেরা আজ যেন তিন ডাইনীর মন্ত্রে
ভয়ানক দীর্ঘকায় হয়ে ট্রাকে জিপে
শহরে টহল দিচ্ছে। যখন তখন
তেড়ে আসে আমার দিকেই
উঁচিয়ে মেশিনগান আর আমি পালিয়ে বেড়াই
জাঁহাবাজ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে দূরে।
কী আশ্চর্য এখন ওদের প্রত্যেকের ঘাড়
গাছের ডালের মতো মটমট ভাঙতে পারলে
আমি ভারি আনন্দ পেতাম।
উদ্ধার
কখনো বারান্দা থেকে চমৎকার ডাগর গোলাপ
দেখে, কখনো-বা
ছায়ার প্রলেপ দেখে চৈত্রের দুপুরে
কিংবা দারুমূর্তি দেখে সিদ্ধার্থের শেলফ-এর ওপর
মনে করতাম,
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড় শান্তিপ্রিয়।
যখন আমার ছোট্র মেয়ে
এক কোণে বসে
পুতুলকে সাজায় যতনে, হেসে ওঠে
ভালুকের নাচ দেখে, চালায় মোটর, রেলগাড়ি
ঘরময়, ভাবি,
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড় শান্তিপ্রিয়।
যখন গৃহিণী সংসারের কাজ সেরে
অন্য সাজে রাত্রিবেলা পাশে এসে এলিয়ে পড়েন,
অতীতকে উস্কে দেন কেমন মাধুর্যে
অরব বচনাতীত, ভাবি-
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড় শান্তিপ্রিয়।
আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা।
অস্ত্রের ঝনঝনা
ধমনীর রক্তের ধারায়
ধরায়নি নেশা কোনো দিন।
যদিও ছিলেন পিতা সুদক্ষ শিকারি
নদীর কিনারে আর হাঁসময় বিলে,
মারিনি কখনো পাখি একটিও বাগিয়ে বন্দুকে
নৌকোর গলুই থেকে অথবা দাঁড়িয়ে
একগলা জলে। বাস্তবিক
কস্মিনকালেও আমি ছুঁইনি কার্তুজ।
গান্ধিবাদী নই, তবু হিংসাকে ডরাই
চিরদিন; বাধলে লড়াই কোনোখানে
বিষাদে নিমগ্ন হই। আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা।
মারী আর মন্বন্তর লোকশ্রুত ঘোড়সওয়ারের
মতোই যুদ্ধের অনুগামী। আবালবৃদ্ধবনিতা
মৃত্যুর কন্দরে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে
অবিরাম। মূল্যবোধ নামক বৃক্ষের
প্রাচীন শিকড় যায় ছিঁড়ে, ধ্বংস
চতুর্দিকে বাজায় দুন্দুভি।
আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা।
বিষম দখলিকৃত এ ছিন্ন শহরে
পুত্রহীন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করুন,
সৈনিক ধর্ষিতা তরুণীকে
জিজ্ঞেস করুন,
যন্ত্রণাজর্জর ঐ বাণীহীন বিমর্ষ কবিকে
জিজ্ঞেস করুন,
বাঙালি শবের স্তূপ দেখে দেখে যিনি
বিড়বিড় করছেন সারাক্ষণ, কখনো হাসিতে
কখনো কান্নায় পড়ছেন ভেঙে-তাকে
জিজ্ঞেস করুন,
দগ্ধ, স্তব্ধ পাড়ার নিঃসঙ্গ যে ছেলেটা
বুলেটের ঝড়ে
জননীকে হারিয়ে সম্প্রতি খাপছাড়া
ঘোরে ইতস্তত, তাকে জিজ্ঞেস করুন,
হায়, শান্তিপ্রিয় ভদ্রজন,
এখন বলবে তারা সমস্বরে, ষুদ্ধই উদ্ধার।
উদ্বাস্তু
আমি কি কখনো জানতাম এত দ্রুত
শহরের চেনা দৃশ্যাবলি লুপ্ত হয়ে যাবে? একটি রাত্রিরে
আমার সারাটা মাথা বিষম রুপালি হয়ে যাবে?
কেমন বদলে গেছি অতি দ্রুত নিজেরই অজ্ঞাতে।
আমার চাদ্দিকে দরদালান কেবলি যাচ্ছে ধসে,
আমার সম্মুখে
এবং পেছনে
দেয়াল পড়ছে ভেঙে একে একে, যেন
মাতাল জুয়াড়ী কেউ নিপুণ হেলায়
হাতের প্রতিটি তাশ দিচ্ছে ছুড়ে। আমি
কত ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে হাঁটি
করাল বেলায়। জনসাধারণ ছিন্ন
মালার মুক্তোর মতো বিক্ষিপ্ত চৌদিকে।
সমস্ত শহর আজ ভয়াবহ শবাগার এক। কোনোমতে
দম নিই দমবন্ধ ঘরে। জমে না কোথাও আড্ডা,
রেস্তোরাঁ বিজন। গ্রন্থে নেই মন, আপাতত জ্ঞানার্জন বড়
অপ্রয়োজনীয় ঠেকে। ঘর ছেড়ে পথে
পা বাড়াতে ভয় পাই। যেদিকেই যাই,
ডাইনে অথবা বাঁয়ে, বিষণ্ন স্বদেশে বিদেশীরা
ঘোরে রাজবেশে। রেস্তোরাঁয়, পার্কে, অলিতে-গলিতে
শহরতলিতে শুধু ভিনদেশী ভাষা যাচ্ছে শোনা।
বস্তুত বিষণ্ন এ শহরে হত্যাময় এ শহরে
স্বদেশীর চেয়ে বিদেশীর সংখ্যা বেশি। নাগরিক
অধিকারহীন পথ হাঁটি, ঘাড় নিচু, ঘাড়ে মাথা
আছে কি বা নেই বোঝা যায়। এই মাথার ওপর
আততায়ী, শাসক সবার
আছে পাকাপোক্ত অধিকার। কেবল আমারই নেই।
যদিও যাইনি পরবাসে, তবু আমি
বিষণ্ন উদ্বাস্তু একজন। ক্লান্ত মনে ধরে ঘুণ, শুধু ঘুণ।