- বইয়ের নামঃ প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অতি পুরাতন বৃষ্টি
মেঘে-ঢাকা রাত্রি নয়, ভরা-দুপুরেই
যখন পরীর মতো গান গেয়ে ওরা আসে এই
বাংলার আকাশ থেকে নিচে
দিগন্তের ঘাসে দক্ষিণের শান্ত বিলে শহরের পিচে
আমারও প্রাণের ভাষা সুর হয়ে ঝরে
এ মাহ ভাদরে।
আবার তোমাকে পাই হৃদয়ের সৃজনী-উত্তাপে
সমস্ত শরীর হয় দীপ্ত শিখা, অন্ধকারে কাঁপে।
মেঘে-ঢাকা এই ভরা-দুপুরের কাছে
হয়তো তোমার কিছু রহস্য-নিবিড় কথা আছে
শুধুবার, তাই চোখে অপার বিস্ময়
তরঙ্গের তরণীর মতো কাঁপে, মনের নিঃশব্দ লোকালয়
দূরগামী উত্তরমেঘের
নিত্যপথে ভাষা পায় বেদনার ব্যাপ্ত আনন্দের।
যে-পথে হাঁটিনি আমি কোনো দিন, সেখানে এখন
স্তব্ধতার সুরে সুরে নেমেছে বর্ষণ
শ্রাবণের। পথের যে-কোনো গাছ, পশু, একা পাখি, সারি সারি বাড়ি
মহাশ্চর্য মেঘ হয়ে যায়
বৃষ্টির ধোঁয়ায়।
কখনো যাবে না চেনা কে ছিল ঘুমিয়ে
না-দেখা পল্লীর
মাটির দেয়াল-ঘেরা দূর ঘরে স্বপ্ন মুড়ি দিয়ে
এমন বৃষ্টির
আচ্ছন্ন দুপুরে মিশে। পাশে তার কেউ
ছিল না কি জেগে একা রমণীর ঘুমের সৌরভে?
যখন প্রাণের সব ঢেউ
জেগে ওঠে, কথা বলে, রক্তের আশ্চর্য কলরবে
বৃষ্টির দুপুরে মনে পড়ে
বর্ষার মতন গাঢ় চোখ মেলে তুমি আছ দু’দিনের ঘরে।
অপাঙ্ক্তেয়
যেহেতু লৌকিকতার দড়িদড়া ছিঁড়ে বেপরোয়া
উঁচিয়ে মাস্তুল সুন্দরের ভাস্বর সে নীলিমায়
ভ্রমণবিলাসী তাই সম্মিলিত মুখর প্রস্তাবে
দিয়েছ উন্মাদ আখ্যা, উপরন্তু চিরশক্র ভেবে
আমাকে করেছ বন্দি সন্দেহের অন্ধ ঊর্ণাজালে।
অথচ নারীর গর্ভে তমসায় নক্ষত্র-খচিত
আয়ুর অবোধ স্বপ্নে জন্মেছি আমিও, দন্তহীন
বাসনায় নিয়েছি অধীর মুখে স্তনাগ্র কোমল,
আর জুয়াড়ির মতো আপনাকে করেছি উজাড়
তীব্রতায় ধাতুর উজ্জ্বল মদে, ধুতুরার ঘ্রাণে।
মিথ্যাকে কখনো ভুলে সুন্দর ফুলের রমণীয়
স্তবকের মতো আমি পারিনি সাজাতে বঞ্চনায়,
বরং করিনি দ্বিধা কণ্ঠে তুলে নিতে আজীবন
সত্যের গরল। ফলত সে উন্নদ্র তৃতীয় চোখ
অন্ধের বিমূঢ় রাজ্যে বাদ সাধে বলে ক্রোধ জ্বলে
বারবার আত্মতৃপ্ত এই অন্ধ কূপের গভীরে।
নেকড়ের মতো সব মানুষের দঙ্গল এড়িয়ে,
মাংসের মূঢ়তা ছেড়ে নৈঃসঙ্গে সম্পন্ন হয়ে চলি;
উত্তপ্ত তোমার মতো শরীরের পৌত্তলিক যেন
অর্পিত, গ্রথিত প্রাণ ভীষণের আগ্নেয় মালায়।
জীবনকে সহজ নিয়মে নেয়া যেত প্রথামতো,
কিন্তু তবু জ্যামিতির নেপথ্যে মায়াবী গুঞ্জরণে
মজেছি স্বতই দুঃখে অর্থ থেকে অর্থহীনতায়।
কুৎসার ধারিনি ধার, বরং নিজেরই আচরণে
বিপন্ন হয়েও শুধু সারাক্ষণ অস্তিত্বের ধার
রেখেছি প্রখর তীক্ষ্ণ আর ব্যালে নর্তকের মতো
চেয়েছি গতির ধ্যানে অনন্তের একটি মাধবী
উন্মোচিত আবর্তিত হৃদয়ের হলুদ আকাশে।
অথচ নিশ্চিত জানি জীবনের সুকান্ত আপেল
অলক্ষিতে রক্তিম চাঁদের মতো ঝরে সুনিপুণ
কীটের সুখাদ্য হবে যথারীতি। মাঝে-মাঝে তবু
নিজের ঘরের ছিদ্রে চোখ রেখে দেখি পৃথিবীকে,
যেমন বিকারী দেখে যুগলের মদির নগ্নতা,
কামকলা, অবসাদ, নিদ্রায় মধুর শিউরনো।
তোমরা সজ্জন সহৃদয়, বলি হৃদয়ের স্বরে
আমাকে গ্রহণ করো তোমাদের নিকানো উঠোনে
নারীর আর শিশুর ছায়ায় আঁকা, রক্তকরবীতে।
আমার জীবনে নেই তৃপ্তির গৌরব, আর আমি
অর্থ খুঁজি চক্রে চক্রে, সমর্পিত মহাশূন্যতায়।
কী অর্থ নিহিত তবে নিপতিত গাছের পাতায়?
অ্যাপোলোর জন্যে
অ্যাপোলো তোমার মেধাবী হাসির সোনালি ঝরনা
শিশু পৃথিবীর ধূসর পাহাড়ে এখনও কি রবে লুপ্ত?
আমরা এখানে পাইনি কখনো বন্ধু তোমার
সোনালি রুপালি গানের গভীর ঝঙ্কার,
শাণিত নদীর নিবিড় বাতাস মানবীর মতো ডাকে চেতনার রাত্রে,
তবুও এখানে আমরা সবাই বিবর্ণ রোগী পৃথিবীর পথে,
হৃদয়ের রং মনের তীক্ষ্ণ ক্ষমতা ফেলেছি হারিয়ে।
ত্র্যাপোলো তোমার মেধাবী হাসির সোনালি ঝরনা
শিশু পৃথিবীর ধূসর পাহাড়ে এখনও কি রবে লুপ্ত?
রাত্রি। রাত্রি। অথই রাত্রি। নীল সমুদ্র মনের কিনারে ফুলছে।
অতিদূর ধু-ধু সময়হীনতা সময়ের কোনো তন্দ্রাকে মুছে
নির্জন সেই আকাশপ্রদীপে, শিশিরে জলে কাঁপছে।
দেয়ালে টাঙানো হরিণের ছালে অরণ্যমতী জীবনের গাঢ় কান্না,
অরণ্য তুমি ক্ষমা করো শুধু-চেতনা প্রসারী।
মহতী গানের ধ্বনি বুকে পুষে তোমাকে ভুলেছি আমরা।
অতিদূর ধু-ধু সময়হীনতা সময়ের কোনো তন্দ্রাকে মুছে
নির্জন সেই আকাশপ্রদীপে, শিশিরের জলে কাঁপছে!
সান্ধ্যভাষার দীপ্তি জড়িয়ে কার যেন এক অপরূপ মুখ ক্ষুব্ধ
ক্ষুব্ধ আমার মনের ক্লান্ত গোধূলি-শিখায়, জানালার প্রীত আকাশে।
চোখের গভীরে সুদূর-অতল কাস্পিয়ানের টলটলে নীল কেঁদেছে,
অত্যাচারের হিংস্র ব্যথায় নিজের হাতেই ছিঁড়েছে বুকের
সোনালি হরিণ দীর্ণ সে-নারী ফাল্গুনি মন হারাল?
তবুও একটি গভীর-রুপালি পূর্ণিমা জ্বলে মানবীর ছেঁড়া হৃদয়ে।
ক্লীব সমাজের প্রবীণ ক্ষমতা কেড়েছে অনেক
প্রণয়ী মনের উজ্জ্বল আর নরম রজনীগন্ধা।
রাত্রি। রাত্রি। অথই রাত্রি। নীল সমুদ্র মনের কিনারে ফুলছে!
অ্যাপোলো শুনছ? নামল এখানে যাদের ধূসর সন্ধ্যা,
পৌষ এসে ডাক দিয়েছে তাদের শূন্য ভাঁড়ারে
ঠোঁটে তুলে নিতে ইঁদুরের মতো মৃত্যু!
ধু-ধু প্রান্তরে আনাগোনা করে ‘প্রাচী’র প্রাচীন ছায়ারা,
ম্লান ঘোড়াদের আর্ত চোখের বিষণ্ন রোদে
খুঁজব কি বলো মধ্যযুগের ক্লান্তি?
নেমেসিস-হাসি কেঁপেছে আবার প্রাণ ঝরে ফের জীবনের মানচিত্রে,
অ্যাপোলো! অ্যাপোলো! প্রবাল ঠোঁটের, চেতনা-প্রসূত-
সোনালি রুপালি মেয়েরা এখানে আসবে?