- বইয়ের নামঃ দুঃসময়ে মুখোমুখি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অতিবর্ষণের পর
অতিবর্ষণের পর ঝলসিত রৌদ্রের স্লোগান
অন্ধকারে টর্চলাইটের মতো। মগ্নতায় দেখি,
হৃদয়ের উঠোনে চন্দনা খাচ্ছে খুঁটে খাদ্যকণা।
আকাশ-গড়ানো রোদ ভালো লাগে, চক্ষুস্থিত আভা
বাতাসে উড্ডীন পায়রার ঝলসানি দেখে আরও
দীপ্তিময় হয়। প্রতিবেশীর কলহ, আপিসের
খাটুনি, গ্রেডের মোহ, খিস্তি, কম্বোডিয়া,
মধ্যপ্রাচ্য, প্রাথমিক শিক্ষককুলের কিছু মুখ,
দুর্ভিক্ষ-শাসিত মুখ, আমার নিজের ছেঁড়া জুতো,
মুদির দোকানে খ্যাঁচামেচি, বাজারের ফর্দ, ভিড়,
বীমার প্রাণান্তকর কিস্তি কেমন তলিয়ে যায়
অদূর পায়রাময় বাতাসের স্নিগ্ধ স্বর শুনে
ভাগ্যিস কয়েক দিন একঘেয়ে বর্ষণের পর
আবার উঠেছে রোদ খিলখিলিয়ে, আকাশের নীল
ব্যানারে কী যেন দেখে চক্ষুদ্বয় প্রীত, হৃদয় তো
প্রজাপতি হতে চায়, মধ্যবিত্ত ছা-পোষা মানস
চায় না বিরোধ কোনো, হাঙ্গামা-হুজ্জতি চক্ষুশূল।
বাজারের থলি হাতে পথ চলি শাক মাছ কিনে
বাড়ি ফিরি, রেশনের লাইনে দাঁড়াই, কখনোবা
ছেলেমেয়েদের ফাঁকি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে সিনেমায়
যাই, রেস্তোরাঁয় খাই। অতিবর্ষণের পর রোদ
কিংবা নীল দেখে মধ্যে মধ্যে খুবই আহ্লাদিত হই।
কখনো চাইনে যুদ্ধ, শবগন্ধময় জনপদ
বিভীষিকা অতিশয়, শ্মশানে নিবাস চায় কেউ?
ব্যাকুল প্রার্থনা করি, পৃথিবীর সব অস্ত্রাগার
কোমল উদ্যান হোক, বোমারু বিমান পারাবত।
অনাবৃষ্টি
আকাশ ভীষণ খাঁ-খাঁ, একরত্তি মেঘ নেই, শুধু
তরল আগুন গ’লে পড়ছে চৌদিকে। এই ধু-ধু
আকাশের দিকে চোখ রাখা দায়। হঠাৎ কখনো
জমে মেঘ; মনে হয়, হয়তোবা বৃষ্টি হবে ঘন,
হৃদয়-ডোবানো বৃষ্টি। কোত্থেকে ডাকাত এসে সব
কালো মেঘ লুট করে নিয়ে যায়; দিগন্ত নীরব।
উঠোনে সজিনা গাছ রৌদ্রাক্রান্ত, আকাশ আবার
বড় খাঁ-খাঁ, দেয়ালে হাঁপায় কাক। বন্ধ্যা রুক্ষতার
অট্রহাসি; এখন আকাশে যদি কোনো গাছ ফুল
ঝরাত অজস্র, ধরো, জুঁই, বেলী, টগর, বকুল্ল
কিংবা কিছু মনোহারি হরিণ করত ছুটোছুটি
তা হলে ঝাঁঝালো রোদে অন্তত জুড়োত চোখ দুটি।
টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছি-খাতার পাতায় যদি জড়ো
হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল্ল বৃষ্টি। অলস পেনসিল
হাতে, বকমার্কা। পাতা-জোড়া আকাশের খাঁ-খাঁ নীল।
অনিদ্রা
ঘুম,
যেন মা দিলেন ডাক আদুরে মাদুরে,
ঘুম, পিতা দিলেন বুলিয়ে মাথা অলীক আঙুলে।
ঘুম, কারো সুরভিত কালো চুলে চোখ মুখ একান্ত ডোবানো,
ঘুম, গাঢ় গোধূলির থিরথিরে হ্রদ,
ঘুম,
জলজ উদ্ভিদ যেন, ভুল অনন্তের ধু-ধু দিকে ভাসমান।
ঘুরে দেয়ালে মানিপ্ল্যান্ট, উচ্ছ্বসিত রঙিন পাখির
মাতাল ভ্রমণ;
ঘুমের দেয়ালে ডাক-পিয়নের নীল হলদে খাম বিলি,
নিরিবিলি ঘরে ফেরা, কৃপণ উঠোনে
পা রেখে স্পাইয়ের মতো মাটির গভীর থেকে স্মৃতি খুঁড়ে তোলা,
কাউকে কোথাও খুঁজে না পাওয়া কখনো,
অচেনা অথচ অতি মনোরম রাস্তা, টুপি-পরা
একজন স্মার্ট পেঙ্গুইন
দ্রুত যান হাইকোর্টে। ক্যালেন্ডার প্রবল হাওয়ায়
দোলে শুধু দোলে
তারিখবিহীন।
ক্যালেন্ডার থেকে এক ঝাঁক হরিয়াল
চকিতে বেরিয়ে আসে, কারো হাত রাজহংসীর গ্রীবার মতো
হয়ে ফের মিশে যায় গাছের শাখায়।
ঘুমের দেয়ালে তুমি নিবিড় লতানো আসো ভিন্ন অবয়বে,
শিয়ামিজ বেড়ালকে বিলাও আদর, যাও ম্যাজিক লণ্ঠনে,
সেতারের মতো বাজো। হাই সোসাইটি তোলে হাই মধ্যরাতে।
আজকাল কী যে হচ্ছে, ঘুম গৃহস্থের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র, বাস্তুত্যাগী।
চলেছি অজস্র ভেড়া গুনে গুনে, বেড়া ডিঙানোর খেলা, তবু
আবেশে আসে না বুজে চোখ।
অনিদ্রা মরুর খাঁ-খাঁ কিংবা পোড়া ভাদ্রের দুপুর,
অনিদ্রা প্রস্রাবখানা, দারুর দুর্গন্ধে ভেজা, বিচ্ছিরি হলুদ
দেয়ালে অশ্লীল লিপি, চিত্র কদাকার।
অনিদ্রা ভ্যানগগের আত্ম-প্রতিকৃতি
কিংবা কাক-ওড়া ফসলের ক্ষেত,
অনিদ্রা তুমুল নজরুল ইসলামী
পদ্য জ্বালাময়ী
অনিদ্রা কণ্বের তপোবনে
রুদ্র, রুক্ষ, কট্রর দুর্বাসা।
আজকাল কী-যে হচ্ছে, সারারাত ধরে,
শুনছি প্রতিটি শব্দ দেয়ালঘড়ির, শয্যা ছেড়ে
দেখি না আয়নায় মুখ, পাছে বোদলেয়ারের মতো
নিজেকেই অন্য কেউ ভেবে
জানাই অভিবাদন, বলি, ‘হ্যালো, কেমন আছেন?
অনিদ্রা আমার শক্র, তবু তার শক্রতাই ঠেকে সহনীয়
কেননা নিশ্চিত জানি তুমিই জননী অনিদ্রার।
আক্রান্ত হ’য়ে
‘কী আছে তোমার কাছে? বের করো চটপট’ বলে
ক’জন উঠতি গুণ্ডা রাখল রিভলবার বুকের ওপর
আচমকা, আমি প্রায় অকম্পিত স্বরে বললাম, ‘এই তো
এখানে আমার বুকে শ্যামলিম শৈশবের নেবুতলা, নানান রঙের
প্রজাপতি, হৈ-হৈ মেলা
পাখির পেলব বাসা, কারো গাঢ় চুম্বনের রঙিন উষ্ণতা,
উনিশ শো বেয়াল্লিশ, তেতাল্লিশ, দুর্ভিক্ষের ছায়া,
ব্যক্তিগত নানাবিধ ক্ষুধা,
এবং দ্বিতীয় বিশ্ব সময়কালীন ঝিকঝিক মালুম ইত্যাদি শব্দাবলি;
আমার পাঁজরে বহু লাশ পলাশ রঙের বিভিন্ন মিছিল,
শ্রাবণ-সন্ধ্যায় ভেজা করুণ শহর,
আমার মুঠোয় কতো কান্না, নিয়নের ঝিকিমিকি
এবং হিরোশিমার নিদারুণ লণ্ডভণ্ড ল্যান্ডস্কেপ, দ্বিখণ্ডিত বঙ্গ,
সংখ্যাহীন উদ্বাস্তুর মুখ এবং আপনাদের পিস্তলের
রঙেন মতন তীব্র হতাশা অথবা
রঙিন শার্টের মতো আশা,
কবিতার জন্যে অন্তহীন ভালোবাসা, শুনুন পকেটে
অসমাপ্ত কবিতার পাণ্ডুলিপি, আইবুড়ো বোনের একটি
চিঠি ছাড়া আর কিছু নেই।
এসব ফালতু বস্তু আপনারা নেবেন কি করুণানিধান?’
হঠাৎ ছিটিয়ে থুতু আমার একান্ত নির্বিকার মুখে ওরা
ধাঁ করে উধাও হল ঝাঁ-ঝাঁ ধোঁয়া ছেড়ে কালো জিপে।
আমার ভেতর কিছু শব্দাবলি ম্যাজেশিয়ানের
তাসের মতন নেচে নেচে
কেবলি কবিতা হতে চায়। সটান নির্ভীক হেঁটে চলি পথ
বক্ষলগ্ন অলৌকিক একটি তালিকা নিয়ে অলক্ষ্যে সবার।