- বইয়ের নামঃ তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ র্যামন পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আজকাল বহু রাত
একজন ধার্মিক যেমন পবিত্র ধর্মগ্রন্থে অকুণ্ঠ বিশ্বাসী,
তেমনি আমিও বিশ্বাস অর্পণ করেছি
আমার প্রতি তোমার গভীর ভালোবাসায়।
এক মোহন, মজবুত সুতোয় গ্রথিত আমরা দু’জন;
আমরা যে-ঘর বানিয়েছি শূন্যের মাঝার
তার একটি ইটকেও খসাবার সাধ্যি নেই কোনো
জলোঠোসের কিংবা ভূমিকম্পের। আমরা পরস্পর
লগ্ন থাকব, যতদিন বেঁচে আছি।
এটাতো খুবই সত্যি আমাদের দু’জনের দেহ আলাদা,
কিন্তু অভিন্ন আমাদের হৃদয়, আমাদের কল্ব।
আজকাল বহু রাত আমি জেগে কাটাই
সুফীর তরিকায়
আর এই নিশি-জাগরণই আমাকে জপিয়েছে,
গভীর নিশীথের নির্ঘুম প্রহরই আমাকে
তোমার নিবিড়তম সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে পারে।
নিদ্রার বালুচরে তোমার পদছাপ হারায় সহজে।
তাই আমি জেগে থাকব
প্রায়শ সারা রাত আর অবিরত
তোমার অস্তিত্ব আমার শিরায় শিরায় ফুটবে
অলৌকিক বুদ্বুদের মতো।
৭/১১/৯৫
আমার চেয়ে অধিক
যখন তোমাকে দেখি ফুলদানি সাজাতে গোলাপ
অথবা রজনীগন্ধা, ক্যামেলিয়া দিয়ে
এবং সোনালী থালা ভ’রে তোলো বেলফুল আর
স্বর্ণচাঁপা এনে,
তখন তোমাকে কী-যে ভালো লাগে আমার, সুপ্রিয়া।
এমনকী যখন ছ্যা ঢালো পেয়ালায়
কিংবা কারো সমুখে এগিয়ে দাও খাবারের প্লেট-
তাতেও শিল্পের সুষমার স্পর্শ থাকে।
জানি তুমি অবসরে কখনো সখনো সূঁচ আর
সুতোয় কাপড়ে খুব মগ্নতায় ফোটাও কত যে
রঙ বেরঙের ফুল। রূপদক্ষ আঙুলের মৃদু
ছোঁয়ায় শিল্পের জন্ম হয়। কখনো-বা সহজেই
রিফু হয় শাল, শার্ট, শাড়ি, আরো কত কিছু।
যখন তোমার কোনো কথা কিংবা আচরণে
বড় বেশি ছিঁড়ে যায় আমার হৃদয়,
তাকে রিফু করবার মতো সূঁচ-সুতো
অথবা দক্ষতা
জগৎ-সংসারে নেই,
এ-সত্য আমার চেয়ে অধিক কে জানে!
১৯/১১/৯৫
আমার মৃত্যুর পরে
আমার মৃত্যুর খবর পেয়ে তুমি অবশ্য
অঙ্গে কোনো শোকবস্ত্র ধারণ করবে না,
তোমার দীঘল চুলও হবে না
আলুলায়িত কোনো উন্মাদিনীর মতো,
তবে তোমার মানসাকাশ ছেয়ে যাবে শোকার্ত মেঘে।
জানি না তুমি তক্ষুণি ছুটে আসবে কি না
আমার বাড়িতে, আমার লাশের উপর লুটিয়ে প’ড়ে
উদ্বেলিত নদী হয়ে উঠবে কি না। না কি শুধু আড়ালে
দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টি ছড়িয়ে দেবে দূরের আকাশে!
হয়তো তখন আমার কিছু কবিতা
উড়ে আসবে তোমার দিকে আদর কুড়াতে,
যেমন আমি
ব্যাকুল হয়ে উঠতাম তোমার স্পর্শের জন্যে,
চুম্বনের প্রত্যাশায়। এক সময়
হয়তো সবার অগোচরে তুমি নেবে বিদায়।
আমার মৃত্যুর পরে কিছুকাল তোমার ভেতরে
চলতে থাকবে ভাঙচুর, মাঝে মধ্যে চোখ দুটো
হয়ে উঠবে শ্রাবণের ভরা নদী;
টেলিফোনে বেজে উঠলে
সারসের মতো, হঠাৎ তোমার হৃৎস্পন্দন যাবে বেড়ে।
না, তুমি আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না আর।
কোনো কোনোদিন
যখন স্নানঘরে নিজের উন্মোচিত যুগল স্তনে চোখ
যাবে, তখন
হয়তো তোমার মনে পড়বে, আমি ওদের
নাম রেখেছিলাম জেদী, স্বর্গীয় ফল।
কিছুকাল মনে মনে শোক পালনের পর আস্তে-সুস্থে
সবকিছুই হয়ে আসবে স্বাভাবিক। স্বামীর সঙ্গে
মাঝে মাঝে রাত্রির তৃতীয় যামে রতিবিহারে জীবনের
তাপমুগ্ধ হবে তুমি,
(মৃত্যু বড় হিম, মৃত্যু বড় দুঃসহ শীতল, প্রিয়তমা)
পুত্রকন্যার প্রতি তোমার স্নেহ বাড়বে বৈ কমবে না
এক রত্তি,
আনন্দে মেতে উঠবে বান্ধবী-সম্মেলনে আগেকার
মতোই।
মাঝে-মাঝ কাউকে কাউকে পাঠাবে
নিজের তৈরি শুভেচ্ছা কেক কিংবা অন্য কোনা
উপহার।
তখন আমার কবরের ঘাসে, কাঁটাগুল্মে, আগাছায়
কখনো নিঝুম রোদ, কখনো হৈ-হৈ বৃষ্টি, কখনো
জ্যোৎস্নার ঝলক, কখনো অমাবস্যা,
কখনো বা হাওয়ার ফোঁপানি।
ক্রমান্বয়ে বয়স বাড়বে তোমার, কেশে ধরবে পাক;
কখনো-কখনো
নাতি-নাতনীর গুলজার আড্ডায় উল্লসিত হয়ে,
ক্লান্ত হয়ে
দাঁড়াবে আয়নার সামনে, মন খারাপ হবে, হয়তো
মনে পড়বে একজন বয়েসী কবির কথা যে তোমার
রূপের তারিফে ছিল মশগুল,
যে তোমার হৃদয়ের গাঙে ভাসিয়েছিল তার
ভাঙা নাও অসীম সাহসে।
হয়তো তোমাকে উপহার-দেওয়া
সেই কবির কোনো কবিতার
বইয়ের পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে
তার ধূসর স্বাক্ষর দেখে হঠাৎ তুমি চমকে উঠবে
নিজেরই অজান্তে।
৭/১১/৯৫
এক ধরনের জিকির
এই তো আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, গাছের পাতা বলেছে, গৌরী।
আমার ঘরের জানলার পর্দা দুলিয়ে
হাওয়া বলে যায়, গৌরী।
ভাশমান মেঘমালা মেদুর স্বরে বলে, গৌরী।
আসমান-পেরুনো পাখির ঝাঁক
নীলিমার কানে কানে আওড়ায়, গৌরী।
পাশের বাড়ির বাগানে ফুল ফুটেই জপে, গৌরী।
আমার বারান্দার ঝুলন্ত ফুলের টবে
এসে বসা প্রজাপতি বলে, গৌরী।
আমার বুক শেলফের বইগুলো সমস্বরে
আলো-ঝরানো স্বরে বলে, গৌরী।
আমার লেখার টেবিল কণ্ঠে আনন্দ-লহরী
জাগিয়ে বলে, গৌরী।
আমার কবিতার খাতা বাউলের মতো
দোতারা বাজিয়ে নেচে নেচে গেয়ে ওঠে,
‘এমন মানব-জনম আর কি হবে,
কতদিন এই হালে যাবে, আমার মনের মানুষ গৌরী।
আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি হৃৎস্পন্দন আর
রক্তকণিকা মনসুর হাল্লাজের মতো জপে গৌরী,
গৌরী, গৌরী…
৯/১২/৯৫
এমন বর্ষার দিনে
চল্লিশটি বর্ষার সজল স্পর্শ তোমাকে আকুল
করে আজো, আজো দেখি তুমি জানালার কাছ ঘেঁষে
বাইরে তাকিয়ে আষাঢ়ের জলধারা দ্যাখো খুব
মুগ্ধাবেশে; মনে হয়, আষাঢ় তোমার মন আর
হৃদয় শ্রাবণ। তুমি এই তো সেদিন ঘন কালো
মেঘদল দেখে, শুনে বৃষ্টির জলতরঙ্গ বল্লে
নিবিড় মেদুর স্বরে, ‘এ বৃষ্টি আমার, এই বর্ষা
আমাকে সস্নেহে তার দীর্ঘ আঙুলে ছুঁয়ে যায়।
এখন দেখছি আমি কবেকার তোমার আঠারো
বছরকে চুমো খাচ্ছে আনন্দে নিভৃতে খোলা ছাদে
কাঁচের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি। বাদল দিনের ফুল
কদমের বুনো ঘ্রাণে শিহরিত তুমি ক্ষণে ক্ষণে।
এমন বর্ষার দিনে তোমার কি সাধ জাগে কেউ
নিরিবিলি টেলিফোনে ‘রাধা’ ব’লে ডাকুক তোমাকে?
২৯/৬/৯৫