- বইয়ের নামঃ ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনঙ্গ বাউল
একজন বাউলের গান আমাকে দু’টুকরো করে
বিকেলের গৈরিক আলোয়- এক টুকরো প’ড়ে থাকে
বাস্তবের ধূসর মাটিতে, এক খণ্ড আসমানি
হাটে খুঁজে ফেরে তন্ন তন্ন ক’রে হারানো মানিক।
নক্ষত্রের করিডর দিয়ে হেঁটে যাই, নীলিমার
রেণু সমুদয় গায়ে লাগে এবং আমাকে করে
আলিঙ্গন উদার সপ্তর্ষি। কামিজের খুঁটে লাগে
টান, আর আমার বিবাগী অংশ মর্ত্যে নেমে আসে।
চাঁড়ালের দল কবিতার আর দর্শনের বই
পোড়ায় হুল্লোড় ক’রে, সারা গায়ে মাখে ভস্মরাশি,
শোণিত-তৃষ্ণায় উন্মাদের মতো ছোটে দিগ্ধিদিক।
প্রশান্ত নদীর কাছে, বৃক্ষের নিকট প্রজ্ঞা ভিক্ষা
চাই, পাখি দেখি আর ছিন্ন মস্তক এ রুদ্র কালে
গান বাঁধে আমার ভেতরকার অনঙ্গ বাউল।
১২/৮/৯৩
অনন্য উৎসব
কখনো কখনো কারো কারো চোখে থাকে খুব ঘোর;
বিশেষত দর্পণের সম্মুখে দাঁড়ালে কান্তিমান যুবা আর
রূপসী তরুণী বশীভূত হয় দর্পের এবং
তারা ভুলে যায় সময়ের আবর্তনে
দর্পণ দর্পেরই গোর। যে যুবক সুখে
প্রত্যহ কামায় দাড়ি, মুখ ধোয়া সুগন্ধি সাবানে,
গুন গুন গান গায়, ঘন চুলে চালায় চিরুনি
দর্পণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে, প্রীত হয় ক্ষণে ক্ষণে,
ভাবীকালে সে-ই একদিন
একটি বিরলকেশ মাথা, হৃতকান্তি, লোলচর্ম
মুখ দেখে আঁৎকে ওঠে। ভয় তাকে হঠাৎ গ্রেপ্তার
ক’রে ফেলে। দর্পণকে যৌবনের করুণ কবর
ভেবে স’রে আসে, মুখ ঢাকে মনস্তাপে।
অথচ যখন তার জন্মদিনে যৌবনের ঝলকের মতো
তাজা রোদ বেজে ওঠে কবিতার ধূসর খাতায়,
জীবনের শেষ বাঁকে এসে দ্যাখে
সে এক অতুলনীয়া নারী তাকে হৃদয়ের বাণী
বাজিয়ে বরণ করে, তখন বয়েসী জন্মদিন
অপরূপ তরুণ দেয়ালি, বেঁচে থাকা এক অনন্য উৎসব।
৯১/৯/৯৫
অভয়াশ্রমের দিকে
তোমার নিকট থেকে দূরে চলে গিয়ে আরো বেশি
কাছে চলে এসেছি সুপ্রিয়া। আজ এইখানে এই
সরাইখানায় বড় একা-একা সংগীতবিহীন শুয়ে থাকি,
ব’সে ভাবি, পায়চারি করি রাজবন্দীর ধরনে।
শোনা যায় কোলাহল আর বন্য পশুর হুঙ্কার,
মাঝে মাঝে আর্তরব। অসহায় তাকাই দেয়ালে,
যেখানে সম্পূর্ণ তুমি প্রস্ফুটিত; কাছে গিয়ে মুখ
প্রগাঢ় চুম্বন করি, স্তনে রাখি হাত। মনে হয়
স্বপ্নের গভীর নাভিমূলে স্থাপিত আমার ওষ্ঠ।
তবে কি এখন শুধু স্বপ্নের সঙ্গেই সহবাস?
যখন আঁধার ব্যেপে আসে কংক্রিটের মহারণ্যে,
হতাশা পাতালে ঠেলে দেয় আমাকে হ্যাঁচকা টানে;
লালনের মতো কেউ উদাসী হাওয়ার গান গেয়ে
জপান তোমারই নাম পরবাসে। ছলছল করে
স্বচ্ছ জল হৃদয়ের কানায় কানায়। ইন্তেজারি
প্রহরে প্রহরে; আমরা তো সব স্বপ্নেরই সন্তান।
স্বপ্নের চাতাল চুরমার হয়ে গেলে ঝাঁপ দিই
জ্যোৎস্নাচমকিত সরোবরে, শরীরে পানির ফোঁটা
নিয়ে খুব আস্তে সুস্থে ওপারে মসৃণ উঠে পড়ি,
সর্বব্যাপী প্রেমহীনতায় তোমার সোনালী হাত
ধ’রে এক অভয়াশ্রমের দিকে স্বপ্নের ভেতরে
হাঁটি, যাকে লোকে ভালোবাসা ব’লে সুখ্যাত করেছে।
অসাধারণ
(আবুল হাশেমকে)
অসাধারণ বাক্তিদের দেখলে লোকজন কেমন
মুগ্ধ তাকিয়ে থাকে। যারা
অসাধারণ তাদের চলনে বলনে সাধারণ মানুষ
কখনো চমক কখনো মহিমা
খুঁজে পায়। তাদের উপমা ওরা সন্ধান করে
সমুদ্র অথবা আকাশে।
ভাবে, আহা, কী মহৎ তাদের হৃদয়,
কী ঐশ্বর্যময় তাদের চিন্তা-ভাবনা। ধন্য ধন্য ব’লে ওরা
চৌদিকে গুলজার ক’রে তোলে, মনে
বানিয়ে নেয় অনিন্দ্য মূর্তি।
অথচ এই অসাধারণ ব্যক্তিদের কারো কারো মন
এঁদো ডোবা, যেখানে মশা আর
নানা ধরনের কীটের আস্তানা, তাদের সংকীর্ণতার চাপে
সুন্দরের নাভিশ্বাস ওঠে, পশ্চাৎপদ
চিন্তার আবর্তে ঘুরপাক খায় অনেকের জীবন,
তাদের নীচতায় মুখ ঢেকে ফেলে নিম্ন মানের মানুষও।
যারা অতি সাধারণ, যাদের কেউ লক্ষই করে না,
যাদের মুখে ফোটে না
কোনো চমক-লাগানো কথা, যাদের সত্তায় আঁটা
নেই অসাধারণত্বের লেবেল,
তাদের কারো কারো মনের ভেতর আছে
উদার আকাশ, অতল সমুদ্র। তাদের ছায়াকে
প্রণতি জানায় দোয়েল, জোনাকি, পূর্ণিমা
এবং গুচ্ছ গুচ্ছ কনকচাঁপা।
২৯/১১/৯৫
অস্বীকৃত তোমার মৃত্যু
পথ ছিল জলশূন্য, সুনসান, ছায়ারা
চেটে নিচ্ছিল ধুলো, বৃক্ষেরা নির্বাক,
অথচ কাহিনী বর্ণনায় উন্মুখ। একা তুমি
অনেক দূর হেঁটে এসে
দাঁড়ালে পথের মোড়ে। তোমার পদ চুম্বন করল
ঝরা পাতা, ফুলের পাপড়ি, রৌদ্রধারা।
কী ছিল তোমার আহ্বানে,
কোন্ সেই ইন্দ্রজাল,
জানা ছিল না।
দেখতে-দেখতে বিরান পথ
হ’য়ে ওঠে জনবহুল। সবার মুখ
তোমারই দিকে উন্মীলিত সূর্যমুখী।
কাতারে কাতারে দাঁড়ালাম আমরা,
সজীব বসন্ত অভিবাদন
জানালো আমাদের ইতিহাস
তোমার ইঙ্গিতে নতুন বাঁক নিলো,
আমরা মুগ্ধ চোখে দেখি,
বহু যুগের বন্ধ দরজা যায় খুলে।
হঠাৎ এক খন্ড কালো মেঘ
ঠাণ্ডা হিংস্রতায় ঢেকে ফেলে তোমাকে।
তোমার নিষ্প্রাণ দেহের সামনে শোকার্ত হৃদয়ে
আমরা দাঁড়ালাম নত মাথায়,
তোমাকে অর্পণ করলাম
ফুলের স্তবক আর প্রতিশ্রুতি।
মনে পড়ল আলোর ঝর্নার মতো
তোমার অঙ্গীকার,
বিদ্যুতের মতো তোমার শপথ,
অন্ধকার রাতে পূর্ণিমার মতো
তোমার বরাভয়।
শোকের মুহূর্তের স্পন্দিত বুকে ধ্বনিত বিজয়-গান।
অস্বীকৃত তোমার মৃত্যু বাংলার মানুষের কাছে;
কেননা, তারা জানে তুমি বেঁচে থাকবে
বসন্তের ফুলসম্ভারে,
তুমি বেঁচে থাকবে তাদের শপথ উচ্চারণে,
তুমি বেঁচে থাকবে মানবিক ভালাবাসায়,
তুমি বেঁচে থাকবে কবির নাক্ষত্রিক পঙ্ক্তিমালায়।
১৮/৭/৯৫