- বইয়ের নামঃ খন্ডিত গৌরব
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
খন্ডিত গৌরব
অভিশপ্ত নগরের ঠোঁট, শিরদাঁড়া, বুক ছুঁয়ে
হাওয়া বয়, কোট নড়ে। তপ্ত দু’টি চায়ের পেয়ালা
গেইশা নারীর মতো, কাকাতুয়া-ঝুটি কাঁপে, কালো
টেবিলে চামচ কথা বলে পিরিচের সঙ্গে, দূরে
গণিকার আলো-নেভা আস্তানায় বিষণ্ন নাবিক
অতিশয় ব্যবহৃত স্তনে হাত রেখে ঘন ঘন
নাক ডাকে, কুকুরের ক্রন্দন, পাড়ায় চৌদিদারি
হাঁকডাক ঝিমধরা নৈঃশব্দ্যকে ভীষণ অসুস্থ ক’রে তোলে।
শব্দের গলিত শবে ব’সে টলমল
আকণ্ঠ করছে পান স্মৃতির কারণ-জল কোনো
পোড়-খাওয়া কাপালিক কবি। রাত্রি তাকে
কোন্ ফাঁকে বানায় আধার লেহনের? ফুল্কি ওড়ে দিগ্ধিদিক।
দশদিকে ঢাকঢোল, খোল কর্তাল, ট্রাম্পেট, বাঁশি;
সমর্থিত রূপসীর মাথায় কাঁটার তাজ কিছু রঙ বাজ
পরিয়ে দিয়েছে, মাথা হেঁট। বিজ্ঞাপিত
সৌন্দর্যে গ্রহণ লাগে বুঝি,
পরমায়ু-পুঁজি কমে। টনক নড়ে না,
তার অঙ্কুশে কাতর জনকের ফসফুস-চেরা
রক্তের ঝলক পিকদানে ঘন ঘন,
ভগ্নীর আগুনে ঝাঁপ বিদেশ বিভুঁইয়ে; লগ্নহীন দিন যায়।
হঠাৎ পুঁতির মালা দুলে ওঠে কিশোরীর,পুঁথিপাঠ, কবে
ঘাসফুলে বুলিয়ে আঙুল আর আঁচলে লুকিয়ে
কিছু কুল ঘরে ফেরে। ইদানীং রূপের খাঁচায় হাঁসফাঁস,
চন্দ্রকর অগ্নিকণা; কে তাকে বাঁচায় ডামাডোলে?
টেকে না অস্থির মন ঘরে সারা দিনমান, সাঁঝ
আজকাল প্রায়শই শ্মশানের পুড়ন্ত শবের
উৎকট গন্ধের মতো, রাত্রির করুণ অপচয়।
কোনো কোনো রাতে লোকপ্রসিদ্ধ বোবায়
ধরে তাকে, মধ্যরাতে শিশু
জননীর বুকে
লগ্ন হ’তে ভয় পায়। সত্তায় কাঁপুনি, ব’সে থাকে
সারারাত; জেগে উঠে বিবাগী শয্যায় শুনি কার
কণ্ঠস্বর? জানালার কাছে
নারকেল গাছে হাওয়া ঢ’লে পড়ে সখীর ধরনে।
একটি রোরুদ্যমান মুখ
যেন কুয়াশার ফ্রেমে আঁটা।
কোথায় হলুদ বাটা? কুকারে চাপানো লাল মাংস?
মাঝে মাঝে উৎসবের আগে
বিউটি পার্লারে রূপচর্চা, কখনো বা মুখ্য কাজে
ধৈর্যচ্যুত, পাশা খেলে, পরাজিত দ্বন্দের সহিত
বারবার তামাশার বিপন্ন শিকার
হ’য়ে আত্মহননের আবৃত্তিতে মাতে। তার সাথে উতস্তত
পুরুষের খচরামি; যামিনী না যেতে চোরাবালি
ডাকে তাকে, বুঝি বা সৌন্দর্য ডোবে পরিত্রানহীন।
প্রচণ্ড কর্কশ কবি ছুঁড়ে দ্যায় জোরদার লতা প্রাণপণে,
ব্যর্থতা সাপের মতো জড়ায় কেবলি
মহাক্রোশে তাকে, চেয়ে থাকে অসহায়;
ফোঁসে ক্রুর বালি; তবু হ্যাজাক নেভে না। ঝাঁক ঝাঁক
পাখি ডানা ঝাপ্টায়, চ্যাঁচায় মাঠ জুড়ে
উড়ে, আবার উঠুক ভেসে মাথা, হিলহিলে
সাপ দিক ঝাঁপ, গল্পগাথা সৃজনবিদিত হোক;
ক্লান্তকণ্ঠ, নাছোড় সাগ্নিক কবি পাক নব্য বাকের বিভূতি।
১৩।৩।৯০
অলীক আশার বাণী
অলীক আশার বাণী শোনাতে আসি নি। গেছি ভুলে
সেই মায়াবৃক্ষ, আশা যার নাম; টুপ টাপ ফল
পড়বে না, যত ইচ্ছে ঝাঁকি দাও। যা-কিছু সম্বল
জমেছিল পুরুষানুক্রমে গ্যাছে সবই, মর্মমূলে
দুর্মর কীটের বাসা; আত্মা বন্দী কুহকিনী-চুলে।
সঙ্গীরা খোঁয়াড়ে তৃপ্ত; ড্রাগ-অয়াডিক্টের আচরণ
কী ক’রে দখল করে সবাইকে? কোথায় শরণ
নেব আজ? থাকবো কি হরদম শূন্যতায় ঝুলে?
সবখানে চন্দ্রবোড়া, শঙ্খিণী, দাঁড়াশ; পথ নেই
পালাবার; পক্ষীরাজ ঘোড়ায় সওয়ার হ’য়ে মেঘে
উড়ে যাবে? রূপকথা শুয়োরের ক্লিন্ন চোয়ালেই
জীর্ণ হচ্ছে ক্রমাগত। দিনরাত্রি চরম উদ্বেগে
কন্টকিত; দশদিকে শুধু মধ্যযুগের বিস্তার,
এরকম ব্যাপক সংকটে নেই কারুরই নিস্তার।
আগুনে রেখেছো হাত
‘আগুনে রেখেছো হাত, পুড়ে যাবে আপাদমস্তক’
ব’লে সে সাগ্নিকা কাঁপে ক্রমাগত দার্পিত আক্রোশে;
ঝরায় আগুন, মণিহারা সর্পিণীর মতো ফোঁসে।
দিইনি উত্তর কোনো, বোবা হ’য়ে ছিলাম নিছক।
এ কেমন রূপ মোহিনীর দেখে ফেলি আচানক?
অমন মধুর হাসি যার ঠোঁটে ক্ষণে ক্ষণে খেলা
করে, যাকে মমতার প্রতিমূর্তি ভাবি সারাবেলা
সে কেন উগরে দ্যায় কালকূট আজ অনর্থক?
আসলে আমি কি ভন্ড, প্রতারক, অত্যন্ত পতিত?
কী এক বিভ্রমে ম’জে নিজেকেই করেছি শিকার
খেলাচ্ছলে; বুঝি তাই সময়ের কাছে প্রতারিত
এই আমি অকস্মাৎ হারিয়ে ফেলেছি স্বাধিকার।
সে-ও কি আমাকে ফেলে রক্তচক্ষু শক্রর দঙ্গলে
যাবে চ’লে নিতম্ব দুলিয়ে দূর গহীন জঙ্গলে?
২২।২।৯০
আমি কি এমনই নষ্ট
আমি কি এমনই নষ্ট? পুঁজ ঝরে নাসারন্ধ্র থেকে,
কষ বেয়ে রক্ত পড়ে সারাক্ষণ? সমস্ত শরীরে
দগদগে ক্ষত আর কিল্বিলে পোকা, ভাবো তুমি?
আমাকে উগরে দিয়ে মৃত্যু কিয়দ্দূরে ব’সে আছে
ফুলবাবু, ভুল ক’রে আনাড়ি তস্কর-প্রায় নিয়ে
গিয়েছিলো শুইয়ে দিতে পুরানো কবরে। আমি কথা
বল্লে বুঝি শ্মশানের ধোঁয়া তোমার দু’চোখে জ্বালা
ধরায়, গড়ায় মেঝেময় পশুর গলিত শব।
তা’ না হ’লে কেন তুমি থাকতে পারো না বেশিক্ষণ
সান্নিধ্যে আমার? কাছে গেলে হঠাৎ ইলেকট্রিক
শক্-খাওয়া ধরনে কেমন ছিট্কে দূরে স’রে যাও।
নরকের ফুটন্ত গন্ধক-গন্ধ পাও? মুখ থেকে
অম্লজল বেরোয়, ফোরায়া যেন; সে পানিতে খাই
হাবুডুবু, ভেসে যাই, চলে হাঙরের স্বৈরাচার।
১৭।২।৯০
আসলে তা’ নয়
ছিঃ। লোকটা কি আহাম্মকরে বাবা,
‘সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না’ বাক্যটি সেই ছেলেবেলা থেকে
শুনে শুনেও পড়ন্ত বেলায়
তার কোনো আক্কেল হলো না। হিঃ হিঃ হিঃ।
ভেবেছিলো, সবকিছুই চলে সরল রেখায়; আসলে যে তা’ নয়, এটা বুঝতে বুঝতে
ওর জীবন এলিয়ে পড়েছে
গোধূলি আকাশে। কিন্তু, বুঝলে কি হবে?
এই এখনো পথে বেরুলে সে চমকে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে,
ভড়কে যায়। কী মুশকিল, ডান দিকের রাস্তা সবাইকে
ভানুমতির খেল দেখিয়ে বাঁ, দিকে
মোড় নেয়, বাঁ দিকের পথ সাপের মতো
এঁকে বেঁকে ডানে মিশে যায়। ব্যাপারটা এরকম,
এদিক-ওদিক এবং ওদিক-সেদিকে
জড়িয়ে যেতে থাকে, যেন মাতালের প্রলাপ।
ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানো হলো-
কাল বিকালে এক বিরাট
জমায়েত রাজধানীতে। বাচাল মাইক্রোফোন দশদিক কাঁপিয়ে
রটিয়ে গেলো, ‘দলে দলে যোগ দিন’। তা ধিন তা’ ধিন।
সেই থেকে মধ্যবয়সী লোকটা
ভাবতে শুরু করলো, দ্রোপদীর শাড়ি। এক ফোঁটে
ঘুম হলো না রাতে। চোখ থেকে অবিরল
পানি গড়িয়ে পুড়ে দু’ গালে।
সারাটা দিন কাটে কাজ-থামানো
অস্থিরতা আর দপদপে উদ্দীপনায়। বিকেল হ’তেই
রত্ত্বয়ানা হয় জমায়েতের উদ্দেশে।
অবাক কান্ড, যেখানে হাজার হাজার লোক
জড়ো হবার কথা, সেখানে শূন্যতা
গেঁয়ো মোড়লের মতো পায়ের ওপর তুলে
হুকো টানছে
আর বেশ দূরে দাঁড়িয়ে কিছু লোক
হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে, যেন মস্ত তামাশা
চলছে একটা। সেই ভিড়ে
ওর মিত্রদের দেখতে পেয়ে লোকটায়
পিলে যায় চমকে; বজের মতো হাঁক দিতে গিয়ে
তার মনে হলো, খুবই মিহি গলার
আহত এক পাখি ভর করেছে কণ্ঠে, সে
নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে থাকে
এবং চতুর্দিকে হিঃ। হিঃ। হিঃ।
ছিঃ লোকটা কী আহাম্মকরে বাবা।
ভেবেছিলো, দেশটার
চোখ গেছে খুলে, চুয়ান্ন হাজার বর্গ মাইল এখন
গনগনে লোহা। এবার
সত্যি সত্যি হবে লড়াই।
এখন সে ডন কিহোতের মতো একাই লড়ুক
উইন্ডমিলের সঙ্গে। ছিঃ। কী বুরবকরে বাবা,
হিঃ। হিঃ। হিঃ!
২৫।১।৯০