- বইয়ের নামঃ এক ধরনের অহংকার
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অমলের মতো
অমলের মতো জানালার ওপারের দৃশ্যাবলি
অক্লেশে মুখস্থ রেখে আজও চাই আমার ঘুমিয়ে
পড়ার আগেই সুধা ফুল নিয়ে আসুক এখানে,
স্বপ্নস্থিত প্রচেষ্টায়। সে আসুক। আমার একান্ত
স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার সমানবয়সী সুধা আর
আমার দুঃখের সখী, সুখের নির্ভুল সহচরী।
যে কোন উদ্যানে সুধা কুড়াতে গিয়েছে ফুল? দাও,
তোমরা আমাকে বলে দাও। আজকাল, যতদূর
জানি, বাগানের কাছে গেলে বিষপিঁপড়ের কামড়
সবাই শরীরে নিয়ে আসে। প্রতীক্ষায় অপলক
একটি পাখির দিকে তাকাতে তাকাতে আমি হই
রঙিন মাংসের পাখি আর ভালোবাসতে বাসতে
ভালোবাসা হয়ে যাই। মাদকদ্রব্যের আস্বাদন
ব্যতিরেকে অগোচরে সাইকেডেলিক চিত্ররাজি
ভেসে ওঠে কী প্রবল বর্ণময়-নিজেরই মগজে
ভ্রাম্যমাণ, মিশরীয় মূর্তির সান্নিধ্যে পৌঁছে যাই।
অতিশয় দ্রুত নব ঘোরাতে ঘোরাতে আর্ত বলি,
ট্রানজিস্টার হে দাও ডেকে দাও সুধাকে আমার।
মৃত্যু, কোনো পত্রহীন লেফাফা যেনবা, প’ড়ে আছে
অদূরে আমার গৃহকোণে; সুযোগ পেলেই ক্ষিপ্র
অন্তর্গত ছটফটে পাখিকে আমার পুরে উড়ে
যাবে হিম শূন্যতায়। ট্রানজিস্টার হে হৃদয়ের
মুঞ্জরিত স্থানীয় সংবাদ ফুলে ফুলে মেঘে মেঘে
ঈষৎ রটিয়ে দাও, যেন সুধা দ্রুত চলে আসে
এ কোন প্লাবন আসে ব্যেপে? ভাসে জগত-সংসার,
রাজা তো অনুপস্থিত, সুধা সে-ও অস্তরাগে লীন।
আঘাটায়
এ কেমন জায়গা? এখানে তো আসতে চাইনি কোনো দিন।
কখনো কি বাস্তবিক এই আঘাটায়
রেখেছি পা এমন জমিনে? ভেবেছিলাম এখানে
গোলাপের চারা
প্রচুর থাকবে পথে পার্কে গেরস্তবাড়ির টবে
ব্যক্তিগত উদ্যানে, অথচ
নরভুক গাছ শুধু কর্কশ, বিদ্বেষপরায়ণ, চতুর্দিকে
ভীষণ দিয়েছে মেলে হিংস্র ডালপালা।
আকাশ দু’ফাঁক করে একটি পা, অতিকায়, লাল,
নেমে আসে ছিত্তিছান করতে এ শহর। অভিশাপ
রেলপথে, নদীপথে, চরে চরে, বকুলতলায়, বারান্দায়
অভিশাপ, প্রহরে প্রহরে
ফুলের প্রতিটি কুঁড়ি কীট হয়ে সুপক্ব জামের মতো ঝরে।
পুরোনো গলির মোড়ে, টার্মিনালে, দরদালানের
ছায়াচ্ছন্ন কোণে
কপট বন্ধুর মতো আপাদমস্তক রহস্যের টোগা প’রে
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু। ঘাতক প্রতিটি ঝোঁপ,
ল্যাম্পপোস্ট, প্রত্যেকটি দেয়াল এক্ষুণি
দেয়ালের গায়ে টলে পড়তে পারে।
বিপুল হাঁ করে
পথঘাট গিলে নিতে পারে ঘরবাড়ি, পথিক দোকানপাট,
ক্ষিপ্রগতি মোটরের ঝাঁক, বাস; ঘাতকের গন্ধ
ভাসে রেস্তোরাঁয়, সিনেমায় আর বিবাহ বাসরে।
আথিবিথি তাকাই অন্যত্র, তবু সেই ক্রুর গন্ধ।
ভেসে আসে সবখানে ধুলায় ঘাসে ঘাসে,
তবে কি লুকাবো মুখ ধ্বনিময় আদিম গুহায়?
চাই না এখানে কোনো শিশু কখনো ভূমিষ্ঠ হোক,
হলে সে নিশ্চিত আঁতুড়েই হবে ভীষণ দণ্ডিত।
চাই না এখানে কোনো তরুণীর বুকে ভালবাসা
একগুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া হয়ে মদির উঠুক জ’লে,
জ্বললে তা মিশমিশে অন্ধকার হবে নিমেষেই।
চাই না এখানে কোনো কবি লিখুন কবিতা আর,
লিখলে তা গাধার পায়ের নিচে কিংবা
নিষ্ঠীবনে, বিষ্ঠায় গড়াবে, ভস্ম হবে বহ্ন্যৎসবে।
একটি কান্নার দিকে হাঁটতে হাঁটতে কী ব্যাপক
ধ্বংসের ভেতর চলে যাই। আমার তো দহলা নহলা করে
কাটে কাল, উপরন্তু শূন্যের সহিত শূন্য ক্রমাগত
যোগ দিয়ে চলি ফলাফলহীন; আমার মনের মতো জায়গা
তবে কি অকূল আয়েন্দায় কোনো শূন্যের উদ্যান?
আততায়ী
এ নিবাসে কে আছেন? খুলুন। অগ্নিক্ষরা
দুপুরে দাঁড়িয়ে ঠায় গলা ফাটিয়ে ডাকছি, কড়া
নেড়ে নেড়ে ক্লান্ত; বহুক্ষণ
পর দরজাটা খুলে দাঁড়ালেন এসে একজন,
সমুন্নত, স্মিত তেজ সত্তাময়, পরনে পোশাক ধবধবে,
সেই কবে কুয়াশার মতো এক অস্পষ্ট শৈশবে
খুব দীপ্ত তাকে দেখেছিলাম তখন, মনে পড়ে।
‘এই কি নিবাস বিশ্বাসের?’ প্রশ্ন করলে তিনি, উদাসীন অকম্পিত স্বরে
বললেন, ‘হ্যাঁ, আমাকেই সবাই বিশ্বাস বলে ডাকে।
তার সুরে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের ছিল না বিরোধ, আমি তাকে
পুনরায় করি প্রশ্ন, ‘আপনার বুক থেকে কেন রক্ত ঝরছে বলুন
অবিরল?’ ‘কবে কোন তামসিক সজারু সন্ধ্যায় আমি খুন
হয়েছি তোমার হাতে, পঞ্জরে খঞ্জর তুমি মেরেছিলে দারুণ হেলায়’,
বলে তিনি আনলেন অভিমানী ভরসন্ধ্যা মধ্যাহ্নবেলায়।
আনাড়ি
যতই হই না কেন মনোযোগী, ভুলচুক ছায়ার মতন
করছে অনুসরণ আমাকে রাত্রিদিন।
এখনও কোকিল বসন্তকে দ্যায় সুরের গৌরব
কী সহজে, পাখি ঠোঁটে খড়-কুটো নতুন বিশ্বাসে বয়ে আনে, বানায় আপন ঘর শিল্পীর নিষ্ঠায়;
হরহামেশাই
দেখি পথে কর্মিষ্ঠ শ্রমিক তোলে মাটি
কোদালের ঘায়ে,
শ্রমের নিপুণ ছন্দে দোলে তার পেশল শরীর।
কী-যে হয় এ আমার, প্রত্যহ কিছু না কিছু ভুল
করে ফেলি, অথচ দেখছি চতুষ্পার্শ্বে কত লোক
তাদের নিজস্ব কাজ সারে চমৎকার
রূপদক্ষতায়।
আমাকে দেখুন,
সামান্য একটা সিগারেট ধরাতে গিয়েই, হায়,
কয়েকটি ঢ্যাঙা কাঠি খরচা করে ফেলি
এবং ছিটিয়ে দি ছাই ঘরময়। বরাবর
ঘর গোছানোর শখ আমার, অথচ যতবার
সোৎসাহে গোছাতে যাই, ততবার সব
নয়-ছয় হয়ে যায় বড় বেশি আর
কখনো বিদেশে গেলে সুটকেশ উথাল-পাথাল
করেও সবচে’
জরুরি জিনিসটাই খুঁজে পাই না বস্তুত।
চেনা মনে করে বারংবার রাস্তার লোকের দিকে
ছুটে যাই, হাত ছুঁই। কিন্তু ভুল ভাঙলে অচেনা
সে ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাইতেও ভুল হয়ে যায়।
যখন কাউকে প্রাণ খুলে
দরাজ গলায়
বিষম ডাকতে ইচ্ছে হয়, আমার কণ্ঠনালিতে
রাজ্যের কুয়াশা এসে জমে; প’ড়ে থাকি এক কোনে
স্বরহীন, অসহায়, একা।
একটি নতুন
কবিতা লেখার জন্যে সারারাত জেগে
থাকার উত্তাপ নিয়ে অস্তিত্বের ভিতর মহলে,
ভোরের আলোয়
জ্বালাধরা টকটকে চোখে দেখি, হা কপাল, সাদা
কাগজে কখন সাজিয়েছি ভুলভাল পঙ্ক্তিমালা,
যেমন ক্যাপ্টেন দ্যাখে লাইনে দাঁড়ানো
তার সেনাদের কারো মাথায় সবুজ
হেলমেট নেই, কারো পায়ে শুধুমাত্র জীর্ণ মোজা,
ঝকঝকে বুট নেই, কেউবা নিদ্রায় জবুথবু।
দোহাই আপনাদের, আপনারা কেউ
আমাকে কখনো
নেভাতে বলবেন না পাড়ার আগুন।
আমি বালতিটা হাতে নিলেই আগুন আরো বেশি
ফুঁসে ফুঁসে উঠবে এবং হয়ে যাবে আরো জেদী।