খাঁচার ভিতর সুচিন পাখি কমনে বাঁইচে রয় – শওকত আলী
খিলগাঁও-এর বাসায় ঘরগুলো বেশ বড় ছিল, বারান্দাটাও ছিল চওড়া। ওদিকে আবার বাচ্চার স্কুল, বাজার, বাসস্ট্যান্ড—সবই ছিল কাছাকাছি। অসুবিধা ছিল শুধু একটাই, আর তা হল, সন্ধ্যাবেলায় প্রায়ই ইলেকট্রিসিটি থাকতো না। একদিন-দু’দিন পরপর সন্ধ্যাটি হতো আর অমনি ঝপ করে নেমে আসতো অন্ধকার। তখন মোমবাতি ধরাও, নইলে কুপি জ্বালাও, কেরোসিন আছে না ফুরিয়ে গেছে তা দেখে লণ্ঠনের চিমনি। মোছে—এইসব হাঙ্গামায় পড়তে হতো। হাঙ্গামা-টাঙ্গামা শেষ করে মেয়েকে পড়াতে বসতে বসতে রাত সাড়ে সাতটা/আটটা বেজে যেতো তখন আবার একসঙ্গে দুই কাজ-মেয়েকে পড়ানো একদিকে আর অন্যদিকে রান্না করা। দুই কাজই একসঙ্গে করতে হতো। শুধু একটা করতে গেলে অন্যটা বাদ পড়ে যেতো। মেয়েকেই যদি শুধু পড়াতো, তাহলে রাতের খাওয়া নিয়ে ঝামেলা হয়ে যেতো। কারণ কর্তার শুধু ভাত নয়, তরকারিও সদ্য রান্না হওয়া চাই। তবু ঝামেলা-টামেলা থাকা সত্ত্বেও সে মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছিল। নীলফামারী থেকে বাস উঠিয়ে ঢাকার এই খিলগাঁওয়ের বাসায় ঠাই গাড়া, সোজা ব্যাপার নয়। তবু সে সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সংসার পেতেছিল। শুধু সংসার পাতাই নয়, নিজে কিছু করতে পারে কি না, সেই চিন্তাও তার মগজের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল।
সকাল ন’টার দিকে আতিক বেরিয়ে যেতো, সেই জন্যে রান্নাবান্নার কাজ শেষ করতে হতো আটটার মধ্যেই। স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই মেয়েকে নিয়ে স্কুলের পথে বেরুতে হতো। মেয়েকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরে আর তার কোনো কাজ নেই। সে স্কুলেই থেকে যেতো তারপর। মেয়ের ছুটি না হওয়া পর্যন্ত। বাসায় ফিরে সে করবেটাই বা কী? একাকি শুধু এঘর-ওঘর করা, নইলে জানালা দিয়ে রাস্তায় মানুষ দেখা তাছাড়া তিন ঘন্টা পর তো আবার মেয়েকে নেওয়ার জন্য আসতেই হবে। সুতরাং সে বাসায় ফিরতো না। অন্য বাচ্চাদের মায়েদের সঙ্গে সে স্কুলের। বারান্দায় নয়তো মাঠের গাছতলায় ঘাসের ওপর বসে আড্ডা দিতো।
স্কুলের নতুন টিচার তাজিন বেগমের সঙ্গে ঐ সময় তার আলাপ হয়। মহিলা একদিন বলে বসেন, আচ্ছা, আপনারা ওভাবে গল্প করে সময় নষ্ট করেন কেন, বলুন তো? অতক্ষণ ধরে কথা বললে মুখ ব্যথা করে না আপনাদের?
তাহলে কী করব?
বইটই সঙ্গে করে আনলেই তো পারেন। বই পড়ে দিব্যি সময়টা কাটিয়ে দেবেন।
বান্টির মা মোটাসোটা ভারিক্কি ধরনের মহিলা। তিনি বলে ওঠেন, বইয়ের কথা বলবেন না ভাই, স্কুল-কলেজে থাকার সময় ওসব অনেক পড়েছি, আর না এখন আমরা সংসারের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত, অন্য পরীক্ষা দিতে পারব না।
আহা, পরীক্ষার কথা আপনাদের কে বলেছে! পরীক্ষার কথাতো আমি বলি নি। তাজিন বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু বান্টির মা কোনো কিছু বলার সুযোগ দেয় না। বলে, হয়েছে ভাই, ঐ পড়াপড়ির মধ্যে আমরা নেই।
তাজিন সমবয়সী হবে বলে মনে হয় শাহিনার; তাই সামান্য ঘনিষ্ঠতাও হয়। একদিন সে জিজ্ঞেস করে বসে, আপনি আগে কোথায় ছিলেন মানে কোন্ স্কুলে?
কোনো স্কুলে ছিলাম না। তাজিন বলতে থাকে। বলে, বাসায় ছিলাম, রান্নাঘরে—এই স্কুলেই আমার প্রথম চাকরি।
নিজের থেকেই তাজিন আরও গল্প শোনায়। তাতে জানা যায়, স্বামীর উৎসাহে সে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হয়ে পরীক্ষা দিয়ে বি.এ. পাস করেছে, তারপর চেষ্টাচরিত্র আর ধরাধরি করেই স্কুলে চাকরিটা পাওয়া।
ওই গল্প শুনে শাহিনা কৌতূহলী হয়েছিল। জানতে চেয়েছিল, আপনার স্বামী নিশ্চয়ই কলেজে-টলেজে আছে?
নাহ্, কীসের কলেজে থাকবেন? এম. এ. পাস করলে তবে না কলেজে চাকরি হবে, ওতো বেকারই থাকে বেশির ভাগ সময়।
তার মানে?
নতুন নতুন সব খবরের কাগজে ঢুকে পড়ে, তার কিছুদিন পর কাগজ বন্ধ হয়ে গেলে বেকার হয়ে যায়।
তাহলে পুরনো ভালো কাগজে ঢুকলেই পারেন।
আরে নাহ্, তাজিনের গলায় কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল। বলেছিল, ভালো কাগজে ঢুকলে ওঁর রাজনীতিটা কে করবে?
তাজিন আরও দুঃখের কথা শুনিয়েছিল। কিন্তু সেসব সে মনে রাখে নি। ওর ঐ প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হয়ে বি.এ. পাস করার খবরটা তার মগজের ভেতরে ঠাই নিয়ে নেয় এবং তাকে খোঁচাতে শুরু করে। তার ফলে সে মনে মনে সুযোগ খোঁজে। স্বামী রত্নটিকে কিছু জানায় না। কেননা তিনি আবার মেয়েদের স্কুল কলেজে লেখাপড়া শেখানোর ঘোর বিরোধী। এমনকি নিজের বাচ্চা মেয়ে সামিনাকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করানোর সময়ও তার আপত্তি ছিল—তার ইচ্ছে ছিল মেয়েকে মসজিদের মক্তবে পাঠানোর। শেষে অনেক বলে কয়ে যখন বোঝানো হলো যে কেজি স্কুলেও আজকাল ইসলাম ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, তখন সাহেবের সম্মতি পাওয়া গেল। সবই ভাল চলছিল। সে দিব্যি তাজিনের কাছ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসটাও চেয়ে নিয়েছিল, তার দেখাও হয়ে গিয়েছিল যে শুধু বাংলা আর ইংরেজিতেই এখন যা আলাদা। অন্যসব বিষয়ের সিলেবাস একই রকম, আট বছর আগে যা ছিল। সে মনে মনে আশা করতে শুরু করে তখন যে, প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে সে আল্লাহর ইচ্ছায় অনায়াসে বি. এ. পাস করতে পারবে। আর যদি সে পাস করতে পারে, তাহলে একটা কাজটাজ জোটানো কি অসম্ভব কিছু? সামিনাদের এই এ্যাপোলো কিন্ডারগার্টেনেই কি তার কাজ জুটতে পারে না?