- বইয়ের নামঃ দিনদুপুরে
- লেখকের নামঃ লীলা মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ঘোতন কোথায়?
সকালে খুব দেরি করে উঠলাম। উঠেই গায়ের চাদরটা এক লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে তারই উপর দাঁড়ালাম। চটি খুঁজে পেলাম না। খালি পায়ে স্নানের ঘরে গেলাম। দাঁত মাজলাম না, তাতে যে সময়টুকু বাঁচল সে সময়টা কলের মুখ টিপে ধরে পিচকিরির মতন দেয়ালে-টেয়ালে জল ছিটোলাম। খানিকটা আবার বাবার তোয়ালের উপরও পড়ল দেখলাম। তারপর চোখে-মুখে জল দিয়ে, মুখ-হাত মুছে সেটাকে তালগোল পাকিয়ে ঘরের কোনায় ছুঁড়ে মারলাম। তারপর একমুখ জল ভরে নিয়ে, শোবার ঘরে গিয়ে জানলা দিয়ে নীচে রাস্তায় একজন বুড়ো লোকের গায়ে পু চূ করে ফেলেই তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে চুলটাকে খুব যত্ন করে আঁচড়াতে লাগলাম।
ততক্ষণে নীচের তলায় মহা শোরগোল লেগে গেছে। পিসিমা দুধের বাটি নিয়ে বলছেন:ঘোতন কোথায়?মা আমার চটি-জোড়া নিয়ে বলছেন:ঘোতন কোথায়?আর সব থেকে বিরক্ত লাগল শুনে যে মাস্টারমশাইও সেইসঙ্গে ম্যাও ধরেছেন: প্রশান্তকুমার কি আজ পড়বে না?ভীষণ রাগ হল। জীবনে কি আমার কোনো শান্তি নেই? এই সক্কাল বেলা থেকে সবাই মিলে পেছু নিয়েছে!
পিসিমাকে সিঁড়ির উপর থেকে ডেকে বললাম– দুধ খাব না। সিঁড়ির নীচে মাকে এসে বললাম–চটি পরা ছেড়ে দিয়েছি। বসবার ঘরে গিয়ে গলা নীচু করে মাস্টারমশাইকে বললাম– মা বলে দিয়েছেন, আজ আমার পেট ব্যথা হয়েছে, আজ আমি পড়ব না। তারপর একেবারে তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে, সারাটা সকাল রোয়াকে রোদ্দুরে বসে বসে পা দোলালাম, আর রাস্তা দিয়ে যত ছ্যাকড়া গাড়ি গেল তার গাড়োয়ানদের ভ্যাংচালাম।
দশটা বাজতেই উঠে গিয়ে বই-টই কতক কতক গুছিয়ে, আর কতক কতক খুঁজেই পাওয়া গেল না বলে ফেলে রেখে, ঝুপ ঝুপ করে একটু স্নান করে নিয়ে, খুব যত্ন করে চুলটা ফের আঁচড়ে নিয়ে খাবার ঘরে গেলাম।
মা জলের গেলাস দিতে দিতে বললেন: হারে মাস্টারমশাই কখন গেলেন। শুনতে পেলাম না তো?
আমি সত্যি করেই বললাম: সে ক-খ-ন চলে গেছেন কেবা তার খবর রাখে!
ভাত কতক খেলাম, কতক চার পাশে ছড়ালাম, কতক পুসিকে দিলাম, আর কতক পাতে পড়ে রইল। মাছটা খেলাম, ডাল খেলাম, আর ঝিঙে, বেগুন ইত্যাদি রাবিশগুলো সব ফেলে দিলাম। মা রান্নাঘর থেকে দেখতেও পেলেন না। ট্রামভাড়াটা পকেটে নিয়ে মাকে বললাম: মা যাচ্ছি। এই পর্যন্ত প্রায় রোজই যেমন হয় তেমনই হল। অবিশ্যি মাস্টারমশাইর ব্যাপারটা রোজ হয় না, তাই যদি হত তাহলে বাবা-টাবাকে বলে মাস্টারমশাই এক মহাকাণ্ড বাধাতেন সন্দেহ নেই।
কিন্তু এরপর থেকে সেদিন সব যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। মনে আছে ট্রামে উঠে ডান দিকের একটা কোনা দেখে আরাম করে বসলাম। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আর খালি মনে হচ্ছে কে যেন আমাকে দেখছে। একবার ট্রামসুদ্ধ সবাইকে দেখে নিলাম, বুঝতে পারলাম না। কে। তারপর আবার যেই বাইরে চোখ ফিরিয়েছি আবার মনে হল কে আমাকে এমন করে দেখছে। যে আমার খুলি ভেদ করে ব্রেন পর্যন্ত দেখে ফেলছে। তাইতে আমার ভারি ভাবনা হল। এমনিতেই নানান আপদ, তার উপর আবার ব্রেনের ভিতরকার কথাগুলো জেনে ফেললে তো আর রক্ষে নেই।
কিছুতেই আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আবার মাথা ঘুরিয়ে ট্রামের প্রত্যেকটি লোককে ভালো করে দেখলাম।
এবার লক্ষ করলাম ঠিক আমার সামনে কালো পোশাক পরা একটি অদ্ভুত লোক। তার মুখটা তিনকোনা মতন, মাথায় গাধার টুপির মতন কালো টুপি, গায়ের কালো পোশাকে লাল নীল হলদে সবুজ চড়াবড়া তারা-চাঁদ আঁকা, পায়ে শুড়ওয়ালা কালো জুতো, দুই হাঁটুর মাঝে হাতে ঝুলছে একটা সন্দেহজনক কালো থলে।
এরকম লোক সচরাচর দেখা। যায় না। অবাক হয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই ভীষণ চমকে উঠলাম। দেখলাম মাথায় টুপি নয়, চুলটাই কীরকম উঁচু হয়ে বাগিয়ে আছে। গায়ে সাধারণ ধুতির উপর কালো আলোয়ান, তাতে ট্রামের ছাতের কাছের রঙিন কাঁচের মধ্যে দিয়ে রং বেরং। হয়ে আলো পড়ছে। আর পায়ে নাকতোলা বিদ্যাসাগরি চটি। খালি হাতের থলেটা সেইরকমই আছে।
কীরকম একটু ভয় ভয় করতে লাগল।
লোকটা খুশি হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল: অতই যদি খারাপ লাগে ইস্কুলে যাও কেন? বড়োরা যখন এতই অবুঝ তাদের কথা মেনে নাও কেন?
আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম: তবে কী করব?
লোকটি বলল: কী করবে? তাকিয়ে দেখো নীল আকাশে ছোটো ছোটো সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। গাছেরা সব ভিজে পাতায় সোনালি রঙের রোদ মেখে বসে আছে। গড়ের মাঠের ধার ঘেঁষে পুকুরটাকে দেখো, ঘোর সবুজ জলে টলমল করছে। আর, টের পাচ্ছ দখিন হাওয়া দিচ্ছে?
তারপর লোকটা তার বড়ো বড়ো ফুটোওয়ালা নাকটা তুলে বাতাসে কী যেন শুকে বলল: , পেঙ্গুইনের গন্ধ পাচ্ছি। গড়ের মাঠের ওপারে, গঙ্গার ওপারে, বঙ্গোপসাগরের ওপারে, ভারত-মহাসাগরের ওপারে, কোনো একটা বরফজমা দ্বীপের উপর সারি সারি পেঙ্গুইন চলাফেরা করছে, তাদের মুখেচোখে রোদ এসে পড়েছে, ঠোঁট দিয়ে ডানা পরিষ্কার করছে, দু-একটা সাদা নরম পালক উড়ে গিয়ে এখানে ওখানে পড়ছে– দেখতে পাচ্ছ না? কী আর বলব, তখন আমি যেন স্পষ্ট ওইসব দেখতে পেলাম, আর আমার সমস্ত মনটা আনচান করে উঠল। মনে হল এমন দিনে কি কেউ ইস্কুলে যায়? এমন পৃথিবীতে কোনো দিনও কেউ ইস্কুলে যায়?