- বইয়ের নামঃ যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
তোমার খবরের জন্য যে আমি খুব ব্যাকুল,
তা নয়। তবে ঢাকা খুবই ছোট্ট শহর। কারো কষ্টের
কথা এখানে চাপা থাকে না। শুনেছি আমাকে
ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
প্রত্যেক রাতে সেই ঘটনার পর নাকি আমাকে মনে পড়ে
তোমার। পড়বেই তো, পৃথিবীতে সেই ঘটনা
তুমি-আমি মিলেই তো প্রথম সৃষ্টি করেছিলাম।
যে-গাধাটার হাত ধরে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে সে নাকি এখনো
তোমার একটি ভয়ংকর তিলেরই খবর পায় নি।
ওই ভিসুভিয়াস থেকে কতটা লাভা ওঠে তা তো আমিই প্রথম
আবিষ্কার করেছিলাম। তুমি কি জানো না গাধারা কখনো
অগ্নিগিরিতে চড়ে না?
তোমার কানের লতিতে কতটা বিদ্যূৎ আছে, তা কি তুমি জানতে?
আমিই তো প্রথম জানিয়েছিলাম ওই বিদ্যূতে
দপ ক’রে জ্বলে উঠতে পারে মধ্যরাত।
তুমি কি জানো না গাধারা বিদ্যূৎ সম্পর্কে কোনো
খবরই রাখে না?
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
যে-গাধাটার সাথে তুমি আমাকে ছেড়ে চ’লে গেলে সে নাকি ভাবে
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শয্যাকক্ষে কোনো শারীরিক তাপের
দরকার পড়ে না। আমি জানি তোমার কতোটা দরকার
শারীরিক তাপ। গাধারা জানে না।
আমিই তো খুঁজে বের করেছিলাম তোমার দুই বাহুমূলে
লুকিয়ে আছে দু’টি ভয়ংকর ত্রিভুজ। সে-খবর
পায় নি গাধাটা। গাধারা চিরকালই শারীরিক ও সব রকম
জ্যামিতিতে খুবই মূর্খ হয়ে থাকে।
তোমার গাধাটা আবার একটু রাবীন্দ্রিক। তুমি যেখানে
নিজের জমিতে চাষার অক্লান্ত নিড়ানো, চাষ, মই পছন্দ করো,
সে নাকি আধ মিনিটের বেশি চষতে পারে না। গাধাটা জানে না
চাষ আর গীতবিতানের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য!
তুমি কেনো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে? ভেবেছিলে গাড়ি, আর
পাঁচতলা ভবন থাকলেই ওষ্ঠ থাকে, আলিঙ্গনের জন্য বাহু থাকে,
আর রাত্রিকে মুখর করার জন্য থাকে সেই
অনবদ্য অর্গান?
শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
আমি কিন্ত কষ্টে নেই; শুধু তোমার মুখের ছায়া
কেঁপে উঠলে বুক জুড়ে রাতটা জেগেই কাটাই, বেশ লাগে,
সম্ভবত বিশটির মতো সিগারেট বেশি খাই।
আমাদের ভালোবাসা
আমাদের ভালোবাসা
একশো মাইল বেগে ঝড় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বয়ে যেতে পারে না কখনো।
আধঘণ্টায় মেঘ ও মানুষ ও গাছপালার হৃৎপিণ্ডে
নতুন জন্মের প্রচণ্ড চিৎকার পুরে দিয়ে মিশে যায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
দিনের পর দিন অবিরাম চলতে পারে না ভূমিকম্প।
মাটি ও মানুষকে কয়েক মুহূর্তে থরথর করে
আলোড়িত এলোমেলো করে থেমে যায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
স্থিরবিদ্যুৎ বলে কিছু নেই নতুন মেঘের আকাশে।
আকাশের এপারওপার একটি তীক্ষ্ণ ছুরিকায় ছিঁড়েফেড়ে
জীবনের মতো অন্ধকার ঝলসে দিয়ে মুহূর্তেই নিভে যায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
পদ্মায় জোয়ার স্থির হয়ে থাকে না কোনো দিন।
তীব্র স্রোতে তার সব রক্তনালি ভরে দিয়ে
গড়িয়ে পড়ে অবধারিত ভাঁটায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
বাঙলার বসন্ত থাকে কয়েক সপ্তাহ।
বনের পর বন উতলা আর হলদে আর চঞ্চল আর লাল
করে চলে যায় অধীর বসন্ত
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
চৈত্রের গোলাপ টকটকে লাল হয়ে জ্বলে তিন চার দিন।
দীর্ঘশ্বাসের মতো এক গোপন বাতাসে
অগোচরে ঝরে যায় অমল পাপড়ি
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
আমাদের দীর্ঘশ্বাসের আয়ু এতো কম।
রক্ত-মাংস আর বুকের ভেতর দিয়ে ঠাণ্ডা নদীর মতো
বয়ে গিয়ে নিঃশেষে মিলায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
তোমার চোখের পাতায় অশ্রুবিন্দু এতো সুন্দর ক্ষণায়ু।
আমাদের অস্তিত্বের মতো টলমল করে উঠে
মুহূর্তেই অনন্তে ঝরে যায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
আমার চোখের সামনে
আমার চোখের সামনে প’চে গ’লে নষ্ট হলো কতো শব্দ,
কিংবদন্তি, আদর্শ, বিশ্বাস। কতো রঙিন গোলাপ
কখনোবা ধীরে ধীরে, কখনো অত্যন্ত দ্রুত, পরিণত হলো
নোংরা আবর্জনায়।
আমার বাল্যে ‘বিপ্লব’ শব্দটি প্রগতির উত্থান বোঝাতো।
যৌবনে পা দিতে-না-দিতেই দেখলাম শব্দটি প’চে যাচ্ছে–
ষড়যন্ত্র, বুটের আওয়াজ, পেছনের দরোজা দিয়ে
প্রতিক্রিয়ার প্রবেশ বোঝাচ্ছে।
‘সংঘ’ শব্দটি গত এক দশকেই কেমন অশ্লীল হয়ে উঠেছে।
এখন সংঘবদ্ধ দেখি নষ্টদের, ঘাতক ডাকাত ভণ্ড আর
প্রতারকেরাই উদ্দীপনাভরে নিচ্ছে সংঘের শরণ। যারা
মানবিক, তারা কেমন নিঃসঙ্গ আর নিঃসংঘ ও
অসহায় হয়ে উঠছে দিনদিন।
আমার চোখের সামনে শহরের সবচেয়ে রূপসী মেয়েটি
প্রথমে অভিনেত্রী, তারপর রক্ষিতা, অবশেষে
বিখ্যাত পতিতা হয়ে উঠলো।
এক দশক যেতে-না-যেতেই আমি দেখলাম
বাঙলার দিকে দিকে একদা আকাশে মাথা-ছোঁয়া মুক্তিযোদ্ধারা
কী চমৎকার হয়ে উঠলো রাজাকার।
আর আমার চোখের সামনেই রক্তের দাগ-লাগা সবুজ রঙের
বাঙলাদেশ দিন দিন হয়ে উঠলো বাঙলাস্তান।
আর্টগ্যালারি থেকে প্রস্থান
দুই যুগ আগে সবে শুরু হয়েছে তখন আমার যৌবন।
কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি যেমন বাঁশির অভ্যন্তর আলোড়িত
হয় সুরে সুরে, সুন্দরে সৌন্দর্যে। স্বপ্নে জাগরণে শুধু চাই
সুন্দর ও সৌন্দর্যকে; আর কিছুকেই চাওয়ার যথেষ্ট যোগ্য
বলে ভাবতেও পারি না। ঘৃণা করি সব কিছু, তীব্র ঘৃণা করি
মুদ্রাকে, তোমরা যেমন ঘৃণা করো আবর্জনাকে। ধ্যান করি
শুধু সুন্দরের, সৌন্দর্যের। অথচ আমার চারদিকে শুধু
পরিব্যাপ্ত বাস্তবতা, আর সেই অশ্লীল নোংরা কদর্যতা,
যাকে মানুষেরা পুজো করে ‘জীবন’ অভিধা দিয়ে। ভিখিরিরা
যাকে সযত্নে লালন করে, বিকলাঙ্গ যাকে ধরে রাখে সারা অঙ্গে;
কুষ্ঠরোগী যাকে বোধ করে দেহের প্রতিটি ক্ষতে; রূপসীর
রূপ যার খাদ্য হয়ে পরিণত হয় মলে। আমি প্রাণভ’রে।
ঘেন্না করেছি সেই কুৎসিত, নোংরা, তুচ্ছ জীবনকে।