- বইয়ের নামঃ রূপা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
আপনার নাম রূপা
আপনার নাম রূপা?
রূপা জবাব দিল না। একটু আগে সে একবার বলেছে তার নাম রূপা। দ্বিতীয়বার আবার নাম জানতে চাওয়া কেন? কিছু কিছু মানুষ আছে, একই প্রশ্ন কয়েকবার করতে ভালোবাসে। তার বাবার বন্ধু সুলতান চাচা এরকম একজন। একই কথা দুবার করে বলবেন, কেমন আছিস মা? কেমন আছিস মা? মুখটা শুকনা কেন? মুখটা শুকনা কেন? অত্যন্ত বিরক্তিকর ব্যাপার।
সোফায় যিনি বসে আছেন তাঁর সঙ্গে অবশ্যি সুলতান চাচার কোনো মিল নেই। সুলতান চাচা ভোতা চেহারার মানুষ। ইনি তা-না। কাটা কাটা চোখ মুখ। পাতলা ঠোঁট। গায়ের রঙ ফর্সা। ফর্সা একটু কম হলে ভাল হত। চোখ মেয়েলি ধরনের সুন্দর। চোখের পল্লব দীর্ঘ। রূপা মনে করার চেষ্টা করলকার লেখায় সে পড়েছে, তার দীর্ঘ আঁখি পল্লব সব সময় চোখে ছায়া ফেলে রাখে। মনে পড়ছে না।
রূপা বলল, আপনি কি চা খাবেন?
খাব।
চায়ে চিনি খান?
চিনি কেন খাব না?
রূপা বলল, অনেকেই চায়ে চিনি খায় না এই জন্যে জিজ্ঞেস করেছি। ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন।
তুমি কি আমার কথায় বিরক্ত হয়েছ?
রূপা তাকিয়ে রইল। তাকে লোকটা তুমি তুমি করে বলা শুরু করেছে। পাঁচ মিনিটের মাথায় আপনি থেকে তুমি। চোখে আঙ্গুল দিয়ে ব্যাপারটা কি বুঝিয়ে দেয়া যায় না? ভদ্রভাবে কাজটা কীভাবে করা যায়? রূপা যদি বলে, না তোর কথায় আমি বিরক্ত হই নি। তুই চুপ করে বসে থাক, আমি তোর জন্যে চা বানিয়ে আনছি। তাহলে সে বুঝবে। ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের কথা বলা সম্ভব না। রূপা রানাঘরের দিকে গেল।
রান্নাঘরের দুটা চুলার কোনটাই খালি নেই। রাতের খাবার রান্না হচ্ছে। রূপাদের কাজের মেয়ে মলিনা হাড়িতে চামুচ নাড়ছে। রূপা বলল, উনি চা খাবেন।
লোকটা কে আফা?
রাশেদ নাম। বাবার কাছে এসেছেন।
মলিনা বলল, লোকটার চেহারা কত সুন্দর দেখছেন আফা? আমি অবাক মানছি। রাজার কুমারের মতো চেহারা।
রূপা বলল, রাজার কুমার হলেই চেহারা সুন্দর হয় না। আফ্রিকার সব রাজকুমার কুচকুচে কালো মোটা ঠোঁট। মোটা নাক।
আফা, উনি বিদেশ থিক্যা আসছে?
হ্যাঁ।
কেমনে বুঝছি জানেন? যারা বিদেশ থাইক্যা আসে তারার স্যুটকেসের হাতায় কাগজ থাকে
রূপা বলল, মলিনা তুমি এত বেশি কথা বল যে মাঝে মাঝে আমার অসহ্য লাগে। ভাল করে দুকাপ চা বানাও।
এখন পারব না আফা। চুলা বন। চুলা খালি হোক চা বানায়া দিব। আপনে যান, উনার সাথে গফ করেন। আমি চা নিয়া আসতেছি। উনি কি রাইতে খাকবে?
জানি না। জিজ্ঞাস করেন। যদি থাকে গেস্টরুম ঠিক করা লাগবে। তিন আইটেম পাকাইছি। অতিথি থাকলে আইটেম বাড়াইতে হবে। ফিরিজে সরপুঁটি মাছ আছে। ড়ুবা তেলে ভাইজা দিব।
এত কথা বল কেন মলিনা?
আপনের সাথেই তো কথা বলি। ছাদে গিয়া অন্য বাড়ির কারো সাথে গফ করি না। আমার অত শখ নাই।
রূপা বসার ঘরে ঢুকল। রাশেদ নামের মানুষটা মেরুন কালারের বিশাল স্যুটকেস খুলে ঘাটাঘাটি করছে। মেয়েদের স্যুটকেসের রঙ হয় মেরুন। এই মানুষটার চোখ যেমন মেয়লি, রুচিত্ত মেয়েলি। স্যুটকেসের কিছু কাপড় মেঝেতে, কিছু সোফায়। রূপা বলল, দুটা মাই বন্ধ। চা দিতে সামান্য দেরি হবে।
চুলা বন্ধ মানে কি? গ্যাস আসছেন? আমি ঠিক করে দিতে পারি। আমার সঙ্গে টুল সেট আছে।
রূপা বলল, চুলা বন্ধ মানে দুটা বানরই এনগেজড। রাতের খাবার তৈরি হচ্ছে।
রাতে কি রান্না?
রূপা অনেক কষ্টে বিরক্তি চাপা দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, জানিনা কি রান্না।
আপনার খুব জানতে ইচ্ছে হলে মলিনাকে জিজ্ঞেস করে জেনে দিতে পারি।
মনিনা কে?
আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে।
তার সঙ্গেতে আমার দেখা হয়েছে। সে-ই দরজা খুলে দিয়েছে। এত মিষ্টি চেহারা। সে যে House Maid বুঝতে পারিনি। রূপা আমি তোমার জন্যে এক প্যাকেট চকলেট এনেছি। ব্রাজিলের চকলেট, একটু তিতকুট ভাব আছে।খেতে খুব ভাল।
থ্যাংক য়্যু।
তোমার নাম তাহলে রাপা!
হ্যাঁ। বারবার নাম জিজ্ঞেস করছেন কেন? নাম পছন্দ হচ্ছে না?
না।
সরি। বাবা আমার নাম রাখার সময় আপনার কথা চিম্বা করেন নি। আপনার কথা মাথায় থাকলে তিনি হয়ত অন্য নাম রাখতেন।
তুমি মনে হচ্ছে আমার কথায় রাগ করেছ। ঘটনা হচ্ছে, আমার সঙ্গে আন্ডার। গ্রাজুয়েটে রূপা ব্যানার্জি নামে এক মেয়ে পড়ত। মেয়েটা গাধা টাইপ ছাত্রী,ঔীষন পাজি। গাঁজা-টাজা খেত। সমস্যাটা এইখানেই।
কী সমস্যা?
তোমার নাম রূপ শোনার পর থেকে বারবার তোমার মধ্যে রূপার ছায়া চলে। আসছে।উচিত না, কিন্তু চলে আমছে।এই ফিলিংসের ইংরেজি একটা নাম আছে। নামটা মনে করতে পারছি না, সরি।
অকারণে সরি বললেন কেন?
তুমিই বা অকারণে রাগ করছ কেন? রূপা ব্যানার্জি অতি পাজি এক মেয়ে, সেই দোষ তো আমার না।
আমার নাম যে রূপা, এই দোষও আমার না। আমি আমার নিজের নাম রাখি নি।
রাশেদ বলল, সরি।
মলিনা ট্রেতে করে দুকাপ চা নিয়ে ঢুকল। রাশেদ বলল, মলিনা আরেক কাপ চা নিয়ে এসো, তিনজন মিলে চা খেতে খেতে গল্প করি। আর এই নাও, এই চকলেটের প্যাকেট তোমার জন্য।
মলিনা হতভম্ব হয়ে তাকালো রূপার দিকে। রূপা বলল, আমি চা খাব না। মলিনা তুমি আমার চা-টা খেতে খেতে উনার সঙ্গে গল্প কর। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলে আসি।