- বইয়ের নামঃ স্বদেশ
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ রবীন্দ্রসংগীত
অয়ি ভুবনমনোমোহিনী, মা
অয়ি ভুবনমনোমোহিনী, মা,
অয়ি নির্মলসূর্যকরোজ্জ্বল ধরণী জনকজননিজননী॥
নীলসিন্ধুজলধৌতচরণতল, অনিলবিকম্পিত-শ্যামল-অঞ্চল,
অম্বরচুম্বিতভালহিমাচল, শুভ্রতুষারকিরীটিনী॥
প্রথম প্রভাত উদয় তব গগনে, প্রথম সামরব তব তপোবনে,
প্রথম প্রচারিত তব বনভবনে জ্ঞানধর্ম কত কাব্যকাহিনী।
চিরকল্যাণময়ী তুমি ধন্য, দেশবিদেশে বিতরিছ অন্ন—
জাহ্নবীযমুনা বিগলিত করুণা পুণ্যপীযূষস্তন্যবাহিনী॥
শতগান। ভারততীর্থ। স্বরবিতান ৪৭
আগে চল্, আগে চল্ ভাই
আগে চল্, আগে চল্ ভাই!
পড়ে থাকা পিছে, মরে থাকা মিছে,
বেঁচে মরে কিবা ফল ভাই!
আগে চল্, আগে চল্ ভাই॥
প্রতি নিমেষেই যেতেছে সময়,
দিন ক্ষণ চেয়ে থাকা কিছু নয়—
`সময় সময়’ ক’রে পাঁজি পুঁথি ধ’রে
সময় কোথা পাবি বল্ ভাই!
আগে চল্, আগে চল্ ভাই॥
পিছায়ে যে আছে তারে ডেকে নাও
নিয়ে যাও সাথে করে—
কেহ নাহি আসে, একা চলে যাও
মহত্ত্বের পথ ধরে।
পিছু হতে ডাকে মায়ার কাঁদন,
ছিঁড়ে চলে যাও মোহের বাঁধন—
সাধিতে হইবে প্রাণের সাধন,
মিছে নয়নের জল ভাই!
আগে চল্, আগে চল্ ভাই॥
চিরদিন আছি ভিখারির বেশে
জগতের পথপাশে—
যারা চলে যায় কৃপাচোখে চায়,
পদধুলা উড়ে আসে।
ধুলিশয্যা ছেড়ে ওঠো ওঠো সবে
মানবের সাথে যোগ দিতে হবে—
তা যদি না পারো চেয়ে দেখো তবে
ঐ আছে রসাতল ভাই!
আগে চল্, আগে চল্ ভাই॥
ভারততীর্থ। স্বরবিতান ৪৭
আজি এ ভারত লজ্জিত হে
আজি এ ভারত লজ্জিত হে,
হীনতাপঙ্কে মজ্জিত হে॥
নাহি পৌরুষ, নাহি বিচারণা, কঠিন তপস্যা, সত্যসাধনা—
অন্তরে বাহিরে ধর্মে কর্মে সকলই ব্রহ্মবিবর্জিত হে॥
ধিক্কৃত লাঞ্ছিত পৃথ’পরে, ধূলিবিলুন্ঠিত সুপ্তিভরে—
রুদ্র, তোমার নিদারুণ বজ্রে করো তারে সহসা তর্জিত হে॥
পর্বতে প্রান্তরে নগরে গ্রামে জাগ্রত ভারত ব্রহ্মের নামে,
পুণ্যে বীর্যে অভয়ে অমৃতে হইবে পলকে সজ্জিত হে॥
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
তোমার মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি,
তোমার আঁচল ঝলে আকাশতলে রৌদ্রবসনী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
যখন অনাদরে চাই নি মুখে ভেবেছিলেম দুঃখিনী মা
আছে ভাঙা ঘরে একলা পড়ে, দুখের বুঝি নাইকো সীমা।
কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি—
আকাশে আজ ছড়িয়ে গেল ঐ চরণের দীপ্তিরাশি!
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী—
তোমার অভয় বাজে হৃদয়মাঝে হৃদয়হরণী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
স্বরবিতান ৪৬
আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে
আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে।
কে আছ জাগিয়া পুরবে চাহিয়া,
বলো `উঠ উঠ’ সঘনে গভীরনিদ্রাগমনে॥
হেরো তিমিররজনী যায় ঐ, হাসে উষা নব জ্যোতির্ময়ী—
নব আনন্দে, নব জীবনে,
ফুল্ল কুসুমে, মধুর পবনে, বিহগকলকূজনে॥
হেরো আশার আলোকে জাগে শুকতারা উদয়-অচল-পথে,
কিরণকিরীটে তরুণ তপন উঠিছে অরুণরথে—
চলো যাই কাজে মানবসমাজে, চলো বাহিরিয়া জগতের মাঝে—
থেকো না অলস শয়নে, থেকো না মগন স্বপনে॥
যায় লাজ ত্রাস, আলস বিলাস কুহক মোহ যায়।
ঐ দূর হয় শোক সংশয় দুঃখ স্বপনপ্রায়।
ফেলো জীর্ণ চীর, পরো নব সাজ, আরম্ভ করো জীবনের কাজ—
সরল সবল আনন্দমনে, অমল অটল জীবনে॥
ভারততীর্থ। স্বরবিতান ৪৭
আপনি অবশ হলি, তবে
আপনি অবশ হলি, তবে বল দিবি তুই কারে?
উঠে দাঁড়া, উঠে দাঁড়া, ভেঙে পড়িস না রে॥
করিস নে লাজ, করিস নে ভয়, আপনাকে তুই করে নে জয়—
সবাই তখন সাড়া দেবে ডাক দিবি তুই যারে॥
বাহির যদি হলি পথে ফিরিস নে আর কোনোমতে,
থেকে থেকে পিছন-পানে চাস নে বারে বারে।
নেই যে রে ভয় ত্রিভুবনে, ভয় শুধু তোর নিজের মনে—
অভয়চরণ শরণ ক’রে বাহির হয়ে যা রে॥
আমরা পথে পথে যাব
আমরা পথে পথে যাব সারে সারে,
তোমার নাম গেয়ে ফিরিব দ্বারে দ্বারে॥
বলব `জননীকে কে দিবি দান,
কে দিবি ধন তোরা কে দিবি প্রাণ’—
`তোদের মা ডেকেছে’ কব বারে বারে॥
তোমার নামে প্রাণের সকল সুর
আপনি উঠবে বেজে সুধামধুর
মোদের হৃদয়যন্ত্রেরই তারে তারে।
বেলা গেলে শেষে তোমারই পায়ে
এনে দেব সবার পূজা কুড়ায়ে
তোমার সন্তানেরই দান ভারে ভারে॥
ভারততীর্থ। স্বরবিতান ৪৬
আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।
আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।
ঘরের হয়ে পরের মতন ভাই ছেড়ে ভাই ক’দিন থাকে?।
প্রাণের মাঝে থেকে থেকে `আয়’ ব’লে ঐ ডেকেছে কে,
সেই গভীর স্বরে উদাস করে— আর কে কারে ধরে রাখে?।
যেথায় থাকি যে যেখানে বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে,
সেই প্রাণের টানে টেনে আনে— সেই প্রাণের বেদন জানে না কে?।
মান অপমান গেছে ঘুচে, নয়নের জল গেছে মুছে—
সেই নবীন আশে হৃদয় ভাসে ভাইয়ের পাশে ভাইকে দেখে॥
কত দিনের সাধনফলে মিলেছি আজ দলে দলে—
আজ ঘরের ছেলে সবাই মিলে দেখা দিয়ে আয় রে মাকে॥