- বইয়ের নামঃ দ্বৈরথ
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
বাথরুমের দরজা খোলা
বাথরুমের দরজা খোলা। লোকা অনেকক্ষণ ধরে বাথরুমে। বিশ্রী রকমের একটা আওয়াজ আসছে। গঁরল-গঁল-গঁরল। একজন মানুষ এমন কুৎসিত শব্দে গার্গল করে কিভাবে? সুন্দর শোভন কিছুই কি মানুষটার নেই?
সোমা হাই তুলল। মাত্ৰ নটা বাজে। এর মধ্যে হাই ওঠার কথা না। কিন্তু এই মানুষটি আশেপাশে থাকলে তার হাই ওঠে। লোকটি অবশ্য বুঝতে পারে না। তাই ওঠার সঙ্গে যে অবহেলার একটা ব্যাপার আছে, তা বোধহয় সে জানেও না। জানলেও তার হয়তো কিছু যায় আসে না।
সোমা।
লোকটার গলার স্বর অবশ্যি মিষ্টি। না, মিষ্টি বলাটা ঠিক হচ্ছে না। পুরুষদের গলা মিষ্টি হয় না। ধাতব একটা ঝংকার শুধু থাকে। এই লোকের তা আছে। শুনতে ভালো লাগে। কথা শুনলে জবাব দিতে ইচ্ছে করে।
এই সোমা।
আসছি।
একটু লবণ দাও।
লবণ দিয়ে কী করবে?
দাঁত ঘষব। শালা দাঁতে পেইন উঠেছে।
সোমা লবণ আনতে গেল। তার কানে ঝনঝন করে বাজছে—দাঁত ঘষব। শালা দাঁতে পেইন উঠেছে। লোটা কি ইচ্ছে করলে শালা শব্দটা বাদ দিতে পারত না? বোধহয় না। এইসব শব্দ তার রক্তে মিশে আছে। এই ঘরে একটা সাদা রঙের বিড়াল আসে। বিড়ালটার একটা চোখ নষ্ট। তাই সে বিড়ালটাকে ডাকে কানাশালি। বিড়ালটাকে শালি না ডাকলে কি চলত না?
সোমা ঝকঝকে একটা পিরিচের ঠিক মাঝখানে খানিকটা লবণ নিল। কিছু ছড়িয়ে গিয়েছিল সাবধানে সে একত্র করল। অসুন্দর কোনকিছুই তার ভালো লাগে না। যদিও তাকে বাস করতে হয় অসুন্দরের মধ্যে।
লোকটা তার হাত থেকে পিরিচ নিল। লবণ কত সুন্দর করে সাজানো সেদিকে সে লক্ষও করছে না। আঙুলে লবণ নিয়ে বিকট ভঙ্গিতে দাঁত ঘষছে। মাঝে-মাঝে থুথু করে থুথু ফেলছে। সোমা বাথরুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁড়িয়ে না থাকলেও চলত, তবুও সে দাঁড়িয়ে আছে। কেন আছে লোকটা কি তা জানে? মনে হয় জানে না।
সোমা।
বল।
শালার রক্ত পড়ছে। মাঢ়ী নষ্ট হয়ে গেছে। নিমের ডাল জোগাড় করতে হবে। টুথপেস্ট ফুপেস্ট দাঁতের বারটা বাজিয়ে দেয়।
কিছু বলবে না বলবে না করেও সোমা বলল, নিমের ডাল কোথায় পাবে?
আছে সবই আছে। ঢাকা শহরে সব আছে। শালার ইন্টারেস্টিং একটা শহর। ভেরি ইন্টারেস্টিং।
ভাত বাড়ব?
বাড়। মিনু হারামজাদী কোথায়?
ঘুনুচ্ছে।
নয়টা বাজতেই ঘুম-হারামজাদী পেয়েছে কী? মাসে সত্তর টাকা দিই ওর মুখ দেখার জন্য? কানে ধরে তোল। এগারটার আগে ঘুমাতে দেখলে থাপ্পড় দিয়ে হারামজাদীর দাঁত ফেলে দেব।
ওর জ্বর। আমি ভাত বাড়ছি—অসুবিধা তো কিছু নেই।
অসুবিধা থাকুক আর না থাকুক, নটার সময় ঘুমাবে কেন? ফাজিলের ফাজিল।
সোমা রান্না ঘরে চলে গেল। খাবার গরম করল। কেটলিতে চায়ের পানি চড়িয়ে দিল। খাওয়াদাওয়ার পর তোকটা এক কাপ চা খায়। আদা দিয়ে কড়া এক কাপ চা। এতে নাকি পিত্ত পরিষ্কার হয়। আজ খাওয়ার আয়োজন ভালো না। ছোট মাছের তরকারি, আলু ভাজা এবং ডাল। মুগের ডাল। লোটার খুব প্রিয় জিনিস। হুসহস শব্দ করে ডাল খাবে। চোখ চকচক করতে থাকবে। খাবার সময় বেশ কয়েকবার বলবেলো হয়েছে। গুড কুকিং। এক নম্বরি ডাল।
তারা খেতে বসতে বসতে দশটা বেজে গেল। বারান্দায় টেবিল। দুজনে বসেছে। মুখোমুখি। লোকটা প্লেটে ডাল নিতে নিতে বলল, মুগের ডাল না-কি?
সোমা জবাব দিল না। লোকটা হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ডালের গন্ধটা ফাইন। মনে হচ্ছে গুড কুকিং হয়েছে। ডাল ভেজে নিয়েছিলে?
হুঁ।
গুড। ভেরি গুড। মুগের ডালের আসল রহস্য ভাজার মধ্যে। অল্প ভাজাও যাবে না, আবার বেশিও ভাজা যাবে না। ডিফিকাল্ট। খুব ডিফিকাল্ট।
সাদা বিড়ালটা চলে এসেছে। লোকটার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। খামচি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। খেতে না দেওয়া পর্যন্ত এরকম করতেই থাকবে। মাঝে-মাঝে কামড়ও দেবে।
সোমা।
বল। কানাশালির আবার পেট হয়েছে—দেখছ? শালি ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে। প্রতি তিন মাসে এক বার করে পেট। অবস্থাটা চিন্তা কর। শালি মনে হচ্ছে বিরাট প্রেমিকা।
সোমা মুখ নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো শুনতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু উপায় নেই। শুনতেই হবে। অসুন্দর কোনো দৃশ্য দেখতে না চাইলে আমরা চোখ বন্ধ করতে পারি। কান বন্ধ করার কোন উপায় নেই।
সোমা।
বল।
শালির লাইগেশন করিয়ে দিলে কেমন হয়? ফুর্তি করে বেড়াবে। পেট হবে না। ফাইন ব্যবস্থা। বিড়ালেরও লাইগেশন হয়। তুমি জান?
জানি না।
হয়। খোঁজ নিয়েছি। বদরুল সায়েবের এক শালা পশু হাসপাতালের কম্পাউন্ডার। তার কাছে শুনলাম। শালিকে পশু হাসপাতালে নিয়ে যাব। কষ্টটা দেখ না, তিন মাস পর-পর-ডালটা ভালো হয়েছে। গুড কুকিং।
সোমা জবাব দিল না। জবাব দেবার কিছু নেই।
লোকটা গম্ভীর গলায় বলল, বিড়াল জানোয়ার ভালো। ফুর্তিফার্তা যা করে মানুষের আড়ালে করে, আর কুকুরের অবস্থাটা দেখ–
সোমা ভাবল লোকটাকে কঠিন কিছু বলবে। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। থাক আজ আর বলে কি হবে? কোনো দরকার নেই। সোমা উঠে পড়ল। লোটা বিস্মিত হয়ে বলল, খাওয়া হয়ে গেল?
হুঁ।
একটা বাটিতে করে শালিকে খানিকটা দুধ খেতে দাও। এখন শালির ভালো মন্দ খাওয়া দরকার। ডালটা ভালো হয়েছে সোমা। গুড কুকিং।
সোমা বাটিতে করে বেশ খানিকটা দুধ বিড়ালটাকে এনে দিল। বিড়ালটা জিত ভিজিয়ে ভিজিয়ে দুধ খাচ্ছে আবার ফিরে যাচ্ছে লোকটার পায়ের কাছে। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আবার ফিরে আসছে বাটির কাছে। সোমার কাছে এক বারও আসছে না। বিড়ালরাও অনেক কিছু বুঝতে পারে।