- বইয়ের নামঃ আরোগ্য
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অতি দূরে আকাশের সুকুমার পান্ডুর নীলিমা
অতি দূরে আকাশের সুকুমার পান্ডুর নীলিমা।
অরণ্য তাহারি তলে ঊর্ধ্বে বাহু মেলি
আপন শ্যামল অর্ঘ্য নিঃশব্দে করিছে নিবেদন।
মাঘের তরুণ রৌদ্র ধরণীর ‘পরে
বিছাইল দিকে দিকে স্বচ্ছ আলোকের উত্তরীয়।
এ কথা রাখিনু লিখে
উদাসীন চিত্রকর এই ছবি মুছিবার আগে।
উদয়ন, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৪১ – সকাল
অলস শয্যার পাশে জীবন মন্থরগতি চলে
অলস শয্যার পাশে জীবন মন্থরগতি চলে,
রচে শিল্প শৈবালের দলে।
মর্যাদা নাইকো তার, তবু তাহে রয়
জীবনের স্বল্পমূল্য কিছু পরিচয়।
উদয়ন, ২৩ জানুয়ারি, ১৯৪১ – সকাল
অলস সময়-ধারা বেয়ে
অলস সময়-ধারা বেয়ে
মন চলে শূন্য-পানে চেয়ে।
সে মহাশূন্যের পথে ছায়া-আঁকা ছবি পড়ে চোখে।
কত কাল দলে দলে গেছে কত লোকে
সুদীর্ঘ অতীতে
জয়োদ্ধত প্রবল গতিতে।
এসেছে সাম্রাজ্যলোভী পাঠানের দল,
এসেছে মোগল;
বিজয়রথের চাকা
উড়ায়েছে ধূলিজাল,উড়িয়াছে বিজয়পতাকা।
শূন্যপথে চাই,
আজ তার কোনো চিহ্ন নাই।
নির্মল সে নীলিমায় প্রভাতে ও সন্ধ্যায় রাঙালো
যুগে যুগে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আলো।
আরবার সেই শূন্যতলে
আসিয়াছে দলে দলে
লৌহবাঁধা পথে
অনলনিশ্বাসী রথে
প্রবল ইংরেজ,
বিকীর্ণ করেছে তার তেজ।
জানি তারো পথ দিয়ে বয়ে যাবে কাল,
কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশবেড়া জাল;
জানি তার পণ্যবাহী সেনা
জ্যোতিষ্কলোকের পথে রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না।
মাটির পৃথিবী-পানে আঁখি মেলি যবে
দেখি সেথা কলকলরবে
বিপুল জনতা চলে
নানা পথে নানা দলে দলে
যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে
জীবনে মরণে।
ওরা চিরকাল
টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল,
ওরা মাঠে মাঠে
বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে।
ওরা কাজ করে
নগরে প্রান্তরে।
রাজছত্র ভেঙে পড়ে,রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে,
জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে,
রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত-আঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।
ওরা কাজ করে
দেশে দেশান্তরে,
অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে,
পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে।
গুরুগুরু গর্জন গুন্গুন্ স্বর
দিনরাত্রে গাঁথা পড়ি দিনযাত্রা করিছে মুখর।
দুঃখ সুখ দিবসরজনী
মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি।
শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-‘পরে
ওরা কাজ করে।
উদয়ন, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ – সকাল
আলোকের অন্তরে যে আনন্দের পরশন পাই
আলোকের অন্তরে যে আনন্দের পরশন পাই,
জানি আমি তার সাথে আমার আত্মার ভেদ নাই
এক আদি জ্যোতি-উৎস হতে
চৈতন্যের পুণ্যস্রোতে
আমার হয়েছে অভিষেক,
ললাটে দিয়েছে জয়লেখ,
জানায়েছে অমৃতের আমি অধিকারী;
পরম-আমির সাথে যুক্ত হতে পারি
বিচিত্র জগতে
প্রবেশ লভিতে পারি আনন্দের পথে।
৭ পৌষ, ১৩৪৭
উৎসর্গ (আরোগ্য)
কল্যাণীয় শ্রীসুরেন্দ্রনাথ কর
বহু লোক এসেছিল জীবনের প্রথম প্রভাতে —
কেহ বা খেলার সাথী, কেহ কৌতূহলী,
কেহ কাজে সঙ্গ দিতে, কেহ দিতে বাধা।
আজ যারা কাছে আছ এ নিঃস্ব প্রহরে,
পরিশ্রান্ত প্রদোষের অবসন্ন নিস্তেজ আলোয়
তোমরা আপন দীপ আনিয়াছ হাতে,
খেয়া ছাড়িবার আগে তীরের বিদায়স্পর্শ দিতে।
তোমরা পথিকবন্ধু,
যেমন রাত্রির তারা
অন্ধকারে লুপ্তপথ যাত্রীর শেষের ক্লিষ্ট ক্ষণে।
উদয়ন, ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ – সকাল
এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক
এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক;
চৈতন্যের শুভ্র জ্যোতি
ভেদ করি কুহেলিকা
সত্যের অমৃত রূপ করুক প্রকাশ।
সর্বমানুষের মাঝে
এক চিরমানবের আনন্দকিরণ
চিত্তে মোর হোক বিকীরিত।
সংসারের ক্ষুব্ধতার স্তব্ধ ঊর্ধ্বলোকে
নিত্যের যে শান্তিরূপ তাই যেন দেখে যেতে পারি,
জীবনের জটিল যা বহু নিরর্থক,
মিথ্যার বাহন যাহা সমাজের কৃত্রিম মূল্যেই,
তাই নিয়ে কাঙালের অশান্ত জনতা
দূরে ঠেলে দিয়ে
এ জন্মের সত্য অর্থ স্পষ্ট চোখে জেনে যাই যেন
সীমা তার পেরোবার আগে।
উদয়ন, ১১ মাঘ, ১৩৪৭ – সন্ধ্যা
এ কথা সে কথা মনে আসে
এ কথা সে কথা মনে আসে,
বর্ষাশেষে শরতের মেঘ যেন ফিরিছে বাতাসে।
কাজের বাঁধনহারা শূন্যে করে মিছে আনাগোনা;
কখনো রুপালি আঁকে, কখনো ফুটায়ে তোলে সোনা।
অদ্ভুত মূর্তি সে রচে দিগন্তের কোণে,
রেখার বদল করে পুনঃ পুনঃ যেন অন্যমনে।
বাষ্পের সে শিল্পকাজ যেন আনন্দের অবহেলা–
কোনোখানে দায় নেই, তাই তার অর্থহীন খেলা।
জাগার দায়িত্ব আছে, কাজ নিয়ে তাই ওঠাপড়া।
ঘুমের তো দায় নেই, এলোমেলো স্বপ্ন তাই গড়া।
মনের স্বপ্নের ধাত চাপা থাকে কাজের শাসনে,
বসিতে পায় না ছুটি স্বরাজ-আসনে।
যেমনি সে পায় ছাড়া খেয়ালে খেয়ালে করে ভিড়,
স্বপ্ন দিয়ে রচে যেন উড়ুক্ষু পাখির কোন্ নীড়।
আপনার মাঝে তাই পেতেছি প্রমাণ–
স্বপ্নের এ পাগলামি বিশ্বের আদিম উপাদান।
তাহারে দমনে রাখে, ধ্রুব করে সৃষ্টির প্রণালী
কর্তৃত্ব প্রচণ্ড বলশালী।
শিল্পের নৈপুণ্য এই উদ্দামেরে শৃঙ্খলিত করা,
অধরাকে ধরা।
উদয়ন, ২৩ জানুয়ারি, ১৯৪১ – দুপুর