- বইয়ের নামঃ জলপদ্ম
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
রিকশা থেকে নামার সময়
রিকশা থেকে নামার সময় ইলা লক্ষ্য করল তার হাত-পা কাঁপছে। বুক ধকধক করছে। হাতের তালু ঘামছে। এত ভয় লাগছে কেন তার? ভয় কাটানোর জন্যে কিছু একটা করা দরকার, কি করবে বুঝতে পারছে না। বাড়িওয়ালার ভাগ্নে হাসান একতলার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। ইলা তার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসল। কারো দিকে তাকিয়ে হাসলে খুসির জবাব দিতে হয়, কিন্তু হাসান কখনো তা করে না। আজও করল না। চা ফিরিয়ে নিল। এই ছেলে কখনো চোখে চোখে তাকায় না। সব সময় মাথা নিচু করে থাকে। সে যদি ইলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসত তাহলে ইলার ভয় খানিকটা কম। অল্প জ্বলে যাওয়া হলুদ রঙ্গের ফুল হাওয়াই শার্ট পরা, ফ্যাকাসে চেহারার এই ছেলে কখনো তা করবে না।
চার টাকা ভাড়া ঠিক করা। ইলা রিকশাওয়ালাকে পাঁচ টাকার একটা নোট দিল। একটাকা ফেরত নেবার নেয়ার অপেক্ষা করল না। এত সময় নেই। অতি দ্রুত তাকে তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠতে হবে। তার মন বলছে–ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে। খুব ভয়ংকর। যদিও সে জানে কিছুই ঘটে নি। দিনে দুপুরে কি আর ঘটবে? ফ্ল্যাটে অন্তু মিয়া আছে। তাকে বলা আছে যেন সে কিছুতেই দরজা না খোলে। আগে জিজ্ঞেস করবে, কে? পরিচিত কেউ হলে বলবে–বিকালে আসবেন। বাসায় কেউ নেই।
অন্তু মিয়ার বয়স সাত বছর। এত বুদ্ধি কি তার আছে? কলিং বেলের শব্দ হতেই সে বোধহয় দরজা খুলে দিয়েছে। গত মঙ্গলারে তাদের পেছনের বাড়ির তিনতলা 6/B ফ্ল্যাটে এ রকম হল। ভদ্ৰচেহারার দুটি ছেলে এসে কলিং বেল টিপেছে। ভদ্রমহিলা দরজার কাছে আসতেই একজন বলল, আপা, আমি মিটার চেক করতে এসেছি। ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন ছেলে দুটি শান্তমুখে ঢুকল। চশমা পর ছেলেটি মিষ্টি গলায় বলল, আপা, চেঁচামেচি করবেন না। এক মিনিট সময় দিচ্ছি। গয়না এবং টাকা-পয়সা রুমালে বেঁধে আমাকে দিন। আমার সঙ্গে পিস্তুল আছে। বলেই সে হাসিমুখে পিস্তল বের করল। ভদ্রমহিলা একবার শুধু তাকালেন পিস্তলের দিকে, তারপরই অজ্ঞান। ভাগ্যিস, জ্ঞান হারিয়েছিলেন নয়ত টাকা পয়সা, গয়না–টয়া সব যেত। নিজেই স্টীলের আলমিরা খুলে সব বের করে দিতেন। জ্ঞান হারানোর জন্যে কিছু করতে পারলেন না। ওরাও চাবি খুঁজে না পেয়ে টেলিভিশনটা নিয়ে চলে গেল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ইলার মনে হল নিশ্চয়ই তাদের ফ্ল্যাটে এরকম কিছু হয়েছে। অন্তু মিয়াকে খুন করে জিনিসপত্র সব নিয়ে চলে গেছে। রক্তে ঘর ভেসে যাচ্ছে। অন্তুর মুখের উপর ভনভন করে উড়ছে নীল রঙের মাছি। এই মাছিগুলিকে সাধারণত দেখা যায় না, শুধু পাকা কাঁঠাল এবং মৃত মানুষের গন্ধে এর উড়ে আসে। ছিঃ এসব কি ভাবছে ইলা!
ফ্ল্যাটের দরজার কাছে ইলা থমকে দাঁড়াল। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। পর্দা ঝুলছে। ইলার ঢুকতে সহিস হচ্ছে না। এমনভাবে বুক কাঁপছে যে মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে। সে দরজা ধরে নিজেকে সামলাল, ভয়ে ভয়ে ডাকল, অন্তু, অন্তু মিয়া। কেউ জবাব দিল না। ইলা নিঃশ্বাস বন্ধ করে পর্দা সরিয়ে ঘরে উঁকি দিল। সোফায় পা তুলে বিরক্তমুখে জামান বসে আছে। এত সকালে সে কখনো অফিস থেকে ফেরে না। রোজই ফিরতে সন্ধ্যা হয়। জামান গম্ভীর গলায় বলল, কোথায় গিয়েছিলে?
ইলা জবাব দিল না। তার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয় নি। এখনো বুক ধড়ফড় করছে। এটা বোধহয় এক ধরনের অসুখ। নয়তু শুধু শুধু সে এত ভয় পাবে কেন? জামান বলল, কথা বলছ না কেন? ছিলে কোথায়?
নিউ মার্কেট গিয়েছিলাম।
দুপুরবেল হুটহাট করে নিউ মার্কেটে যাবার দরকার কি? দুদিন আগে 6/B ফ্ল্যাটে এত বড় একটা ঘটনা ঘটল। নিউ মার্কেটে গিয়েছিলে কেন?
উল কিনতে।
উল দিয়ে কি হবে?
একটা সোয়েটার বানাব।
সোয়েটার টায়েটার আজকাল কেউ ঘরে বানায় না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। বাজারে সস্তায় পাওয়া যায়। দেখি ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও।
পানি আনতে গিয়ে ইলা লক্ষ্য করল অন্তু ভেতরের বারান্দায় রেলিংয়ের দিকে মুখ করে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর শরীর ফুলে ফুলে ফুলে উঠছে তাতে মনে হচ্ছে কাঁদছে। জামান কি কিছু বলেছে অন্তুকে? থাক, এখন জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। পরে জিজ্ঞেস করা যাবে।
জামান পানির গ্লাস হাতে নিতে নিতে বলল, অন্তুকে তুমি কি বলে গিয়েছিলে? সে কিছুতেই দরজা খুলবে না। যতবারই বলি–আমি, দরজা খোল ততবারই সে বলে–কেডা? চড় লাগিয়েছি।
ইলা বলল, আহা মারলে কেন? ছোট মানুষ।
ছোট হলে কি হবে, ঝাড়ে বংশে বজ্জাত। খুব কম করে হলেও আধ ঘণ্টা দরজা ধাক্কিয়েছি। সে বুঝতে পারছে আমি, তারপরেও দরজা খুলবে না। দেখি পরিষ্কার একটা রুমাল দাও তো। বেরুব।
কোথায় যাবে?
জয়দেবপুর। ফিরতে দেরি হবে। রাত বারটা—একটা বেজে যাবে। বাড়িওয়ালাকে বলবে দয়া করে যেন গেটটা খোলা রাখে। ব্যাটিা উজবুক, দশটা বাজতেই গেট বন্ধ করে দেয়। এটা যেন মেয়েদের হোস্টেল।
ইলা ক্ষীণ গলায় বলল, আমি কি মার বাসা থেকে একবার ঘুরে আসব? শুনেছি ভাইয়ার জ্বর। ভাইয়াকে দেখে আসতাম।
সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ফিরে আসতে পারলে যাও। এত রাতে একা ফেরার প্রশ্নই উঠে না। শহরের অবস্থা যা মেয়েদের তো ঘর থেকে বের হওয়াই উচিত না।
একা ফিরব না। ভাইয়া পৌঁছে দেশে।