- বইয়ের নামঃ ময়ূখ চৌধুরীর ছোটো গল্প
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ ছোট গল্প
অগ্নি পরীক্ষা
১৯৪২ সাল, ৭ নভেম্বর।
পূর্বোক্ত তারিখে মধ্য আফ্রিকার নগানচু নামে এক ফরাসি উপনিবেশকে কেন্দ্র করে শুরু হচ্ছে আমাদের কাহিনি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নরমেধ যজ্ঞ চলছে দেশে দেশে। ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার সর্বত্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আগুন সর্বগ্রাসী দাবানলের মতো। কাফ্রিদের দেশ আফ্রিকাও রণদেবতার কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হল না।
আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের ওপর ফ্যাসিস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হল দুই মিত্রপক্ষ ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড। জার্মানির ফ্যাসিস্ট বাহিনি তখন ফ্রান্সে পদার্পণ করেছে, কিন্তু আফ্রিকার বুকে ছোটো ছোটো ফরাসি সৈন্যদল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড উৎসাহে। ইংরেজ ও ফরাসির আর এক বন্ধু আমেরিকা যানবাহন ও কলকবজার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কিছু লোজন পাঠিয়ে যুধ্যমান মিত্রপক্ষকে সাহায্য করেছিল।
যাদের দেশের ওপর এই ভয়াবহ তাণ্ডব চলছিল, সেই নিগ্রো নামধারী কালো মানুষরা কিন্তু কোনো পক্ষেই যোগ দেয়নি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশের সাদা মানুষরা শোষণ করেছে আর উৎপীড়ন চালিয়েছে হতভাগ্য নিগ্রোদের ওপর, আজ তারা বুঝেছে সাদা মানুষ মাত্রেই কালো চামড়ার শত্রু
অতএব আত্মকলহে দুর্বল সাদা চামড়ার মানুষগুলোকে ঘায়েল করার এই হচ্ছে উপযুক্ত সময়।
নিগ্রোরা ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্বেতাঙ্গদের ওপর।
ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি কোনো শ্বেতকায় জাতিকেই তারা নিষ্কৃতি দিল না। বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ জাতির ওপর হানা দিয়ে ফিরতে লাগল বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিগ্রো যোদ্ধার দল।
রক্ত আর আগুনের সেই ভয়ংকর পটভূমিকায় ১৯৪২ সালের ৭ নভেম্বর মধ্য আফ্রিকার ফরাসি উপনিবেশ নগানচু নামক স্থানে উত্তোলন করলাম বিস্মৃত ইতিহাসের যবনিকা।
নগানচুতে একটি ফাঁকা মাঠের ওপর যেখানে ফরাসিদের সারি সারি শিবির পড়েছে, সেইখানে খুব সকালেই শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা গেল!
চাঞ্চল্যের কারণ ছিল—
চারজন ফরাসি সৈনিক একটি বন্দিকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে নিকটবর্তী অরণ্যের দিকে!
সেনাবাহিনীর এলাকা ছাড়িয়ে একটি গাছের কাছে তারা স্থির হয়ে দাঁড়াল।
বন্দি জার্মান নয়, স্থানীয় অধিবাসী কৃষ্ণকায় নিগ্রো।
বন্দির অপরাধ গুরুতর; বিগত রাত্রে সেনানিবাসের এক প্রহরীকে সে আক্রমণ করেছিল।
আক্রমণ সফল হয়নি। লোকটি ধরা পড়েছে।
সারারাত্রি সে ছিল বন্দি শিবিরে আজ সকালে তার বিচার।
খুব তাড়াতাড়ি শেষ হল বিচার-পর্ব।
বন্দির দু-খানা হাত কবজি থেকে কেটে ফেলে ফরাসিরা তাকে মুক্তি দিলে। অবশ্য ক্ষতস্থানে ঔষধ প্রয়োগ করে তার রক্তপাত বন্ধ করা হয়েছিল–অতিরিক্ত রক্তপাতে লোকটি যাতে মারা না যায় সেইজন্যই এই ব্যবস্থা।
আহত নিগ্রোর কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল অবরুদ্ধ ক্রন্দনধ্বনি।
স্খলিত-চরণে সে পদচালনা করলে বনের দিকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই অরণ্যের অন্তরালে অদৃশ্য হল তার দেহ।
বন্দির হস্তছেদন করেছিলেন মেজর জুভেনাক স্বহস্তে।
রক্তাক্ত তরবারি খাপে ঢুকিয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করার উপক্রম করলেন, কিন্তু হঠাৎ অদূরে দণ্ডায়মান তিনটি শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের দিকে আকৃষ্ট হল তার দৃষ্টি।
ওই তিনটি মানুষের মুখের রেখায় রেখায় ফুটে উঠেছে ক্রোধ ও ঘৃণার অভিব্যক্তি!
মেজরের বিচার তাদের পছন্দ হয়নি!
মেজর জুভেনাক ভ্রূকুঞ্চিত করলেন, তোমরা আমেরিকার মানুষ; নিগ্রোদের সম্বন্ধে তোমাদের কোনো ধারণা নেই। লোকটিকে প্রাণদণ্ড দিলে স্থানীয় বাসিন্দারা এই ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যেত। কিন্তু হাতকাটা জাতভাই-এর অবস্থা দেখে ওরা ভয় পাবে, ভবিষ্যতে ফরাসিদের আক্রমণ করতে ওরা সাহস করবে না।
জুভেনাক চলে গেলেন।
নিজের ব্যবহারের জন্য কৈফিয়ত দেওয়ার অভ্যাস মেজরের ছিল না। জুভেনাক অতিশয় দাম্ভিক মানুষ। কিন্তু ওই তিন ব্যক্তি ফরাসি গভর্নমেন্টের বেতনভোগী সৈনিক নয়, ওরা আমেরিকার নৌ-সেনা। নিকটস্থ নদীর ওপর মোটর বোট এবং ছোটো ছোটো জলযানগুলি পরিদর্শন করার মতো উপযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার বা কলাকুশলী নগানচু অঞ্চলে ফরাসিদের মধ্যে ছিল না। । তারা আমেরিকার সাহায্য চেয়েছিল।
তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে জলযানগুলির তত্ত্বাবধান করতে এসেছিল আমেরিকার নৌ-বিভাগের তিনটি সৈনিক।
নৌ-বিভাগের অন্তর্গত তিন ব্যক্তির নাম–মাইক স্টার্ন, ম্যাক কার্থি এবং হ্যারিস।
পূর্ববর্ণিত রক্তাক্ত দৃশ্যের অবতারণা যেখানে হল সেখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল ওই তিনজন নৌ-সেনা। মেজর প্রস্থান করতেই হ্যারিস বন্ধুদের জানিয়ে দিলে জুভেনাকের নিষ্ঠুর আচরণ তার ভালো লাগেনি।
হ্যারিসের অপর দুই বন্ধুও তাকে সমর্থন জানিয়ে বললে যে উক্ত ফরাসি মেজরের সান্নিধ্য তারা পছন্দ করছে না।
তিন বন্ধুর ভাগ্যদেবতা অলক্ষ্যে হাসলেন।
তাদের মনস্কামনা শীঘ্রই পূর্ণ হল বটে কিন্তু জুভেনাকের সান্নিধ্য থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের মনের ভাব হয়েছিল–
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই।
যাহা পাই তাহা চাই না..
হস্তছেদন ঘটিত ভয়াবহ ঘটনার পর একটা দিন কেটে গেল নির্বিবাদে। দ্বিতীয় দিন সকাল বেলা তিন বন্ধু দেখল, ফরাসিরা সাজসরঞ্জাম গুটিয়ে স্থান ত্যাগ করার উপক্রম করছে।