- বইয়ের নামঃ নির্বাচিত প্রবন্ধ
- লেখকের নামঃ মোতাহের হোসেন চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
দুঃখবাদ
অন্যান্য কালের মতো একালেও ভাবা হচ্ছে :প্রাজ্ঞ লোকেরা যখন এই ধারণায় উপনীত হয়েছেন যে, এই পৃথিবী দুঃখময়–এখানে বঁচবার মতো কিছুই নেই, তখন এখানে সুখ প্রত্যাশা না-করাই ভালো। যাদের কথা বলা হল তারা যদি বৈরাগী হতেন তো এক কথা ছিল, কিন্তু তারা যখন নিজেরাই ভোগী-শিরোমণি তখন তাদের কথায় আর আস্থা স্থাপন না করে থাকা যায় না। আপনি যদি সত্যি সত্যি একটা ফল মুখে দিয়ে থু করে মুখ বাঁকান তো আমার আর ও ফলটি চেখে দেখবার সাধ থাকতে পারে না। আপনার দেখাদেখি আমারও থু করে মুখ বাঁকাবার ইচ্ছে হবে। অতিভোগের পরে প্রতিষ্ঠ সংস্কৃতিবানরাই যখন মুখ বাঁকান–যেন তেতো কিছু খাচ্ছেন এমনিভাবে, তখন সংস্কৃতির নতুন দাবিদাররাও যে তা-ই করতে চাইবে তাতে আর আশ্চর্য কী? সকলেই তো উঁচু নাকের পরিচয় দিতে ভালোবাসে, আর উঁচুনাকঅলা সাজবার সহজ উপায় হচ্ছে পৃথিবীতে উপভোগ করবার মতো কিছুই নেই, এমনি ভাব দেখানো।
এই ধারণার বশবর্তীরা সত্যই দুঃখী। কিন্তু সাধারণের দুঃখ আর তাদের দুঃখের মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। সাধারণ লোকেরা তাদের দুঃখের জন্য গর্ববোধ করে না, কিন্তু তারা করে। জগতে উপভোগ্য কিছুই নেই, একথা বলে তারা একটা উন্নাসিক শ্রেষ্ঠতাবোধের পরিচয় দেয়। তাদের গর্ব দেখে সাধারণের মনে একটা খটকা লাগে :’দুঃখের জন্য গর্ব’, তা আবার কীরকম ব্যাপার? এ তো সোনার পাথরবাটির মতো একটা অসম্ভব কিছু। হয় তাদের গর্বটা মিথ্যা, নয় দুঃখটা–এই তাদের সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায়। সত্যি-কথা। দুঃখের মধ্যে যে আনন্দ পায়, তার আবার দুঃখ কিসের? তার শ্রেষ্ঠতাবোধের মধ্যেই তো একটা ক্ষতিপূরক দিক রয়েছে। কিন্তু তাই বলে তাকেই যথেষ্ট বলা যায় না। অহঙ্কারবোধ যে-সুখের যোগান দেয়, প্রকৃত সুখের তুলনায় তা অকিঞ্চিৎকর।
নিজেকে দুঃখী ভেবে গর্ববোধ করার মধ্যে কোনপ্রকার উন্নত ধরনের যৌক্তিকতা আছে বলে আমার মনে হয় না। তা বিকৃত বুদ্ধিরই পরিচায়ক। দুঃখের জন্য গর্ব না করে বুদ্ধিমান মানুষ যতটা সম্ভব সুখ আদায় করে নিতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তারা যদি মনে করে জাগতিক চিন্তা একটা সীমা পেরিয়ে গেলেই সুখের কারণ না হয়ে দুঃখের কারণ হয়ে দঁড়ায় তো তারা জগতের চিন্তা না করে অন্য কিছুর চিন্তা করবে। মোটকথা, সুখের দিকেই তাদের ঝোঁক হবে, দুঃখের দিকে নয়। দুঃখই সত্য একথা প্রমাণ করতে গিয়ে যারা বিশ্বপ্রকৃতির মূলেই দুঃখের নিদান দেখতে পায়, তারা প্রকৃতপক্ষে ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করে। আসল ব্যাপারটি এই যে, নিজের দুঃখের কারণটি বের করতে না পেরে তারা শেষে বিশ্বপ্রকৃতির ওপরেই সমস্ত দোষ চাপিয়ে দেয়। বিশ্বপ্রকৃতিতে যে-সকল নৈরাশ্যব্যঞ্জক দিক রয়েছে তাদের উপর আঙুল রেখে বলে : বিশ্বের মূলেই যখন নিষ্ঠুরতা, তথা দুঃখের খেলা তখন তার থেকে সুখ প্রত্যাশা না-করাই যুক্তিসঙ্গত। এসো, সুখের কামনা ভুলে গিয়ে নিজেকে দুঃখের জন্য প্রস্তুত করে তুলি; তা হলেই আর প্রবঞ্চিত হওয়ার ভয় থাকবে না। মিথ্যা খেয়ালি পোলাও খাওয়ার চেষ্টা না করে যা সত্য, নিষ্ঠুর হলেও তাকে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।
ওপরে যে-দুঃখবাদী দর্শনের উল্লেখ করা হল, আমেরিকার পাঠকদের জন্য তা পরিবেশন করেছেন জোসেফ উড ক্রুচ তাঁর ‘দি মডার্ন টেম্পার’ নামক গ্রন্থে। আমাদের পিতামহদের জন্য তা পরিবেশন করেছিলেন কবি বাইরন। আর সমস্ত কালের লোকদের জন্য তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন ‘ইকলেজিয়েটসের লেখক। ক্রুচ বলেছেন :
আমাদের কোনো ভরসা নেই। প্রাকৃতিক বিশ্বে আমাদের জন্য এতটুকু সুখের স্থানও নেই। তথাপি মানুষ হয়ে জন্মেছি বলে আমরা দুঃখিত নই। পশু হিসেবে বাঁচার চেয়ে মানুষ হিসেবে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
আর বাইরন যা বলেন তা তো সকলের জানা :
যে আনন্দ নিয়ে যায় কাল, কভু নাহি দেয় তাহা ফিরে,
যৌবনের ভাবের গরিমা ডুবে কা–যায়-সিন্ধু নীরে।
এখন ইকলেজিয়েটসের লেখকপ্রবর কী বলেন, দেখা যাক। তিনি বলেন :
এইজন্যই আমি বেঁচে থাকা মানুষদের চেয়ে মরে যাওয়া মানুষদের অধিক গুণকীর্তন করি। হাঁ, তাঁদের চেয়েও ভালো হচ্ছেন তাঁরা যারা এখনও জন্মাননি। এবং সেহেতু সূর্যের আলোর নিচে যেসব মন্দ ব্যাপার ঘটে তা প্রত্যক্ষ করেননি।
এই অশুভদর্শী ব্যক্তিত্রয়ের প্রত্যেকে প্রচুর সুখভোগের পরেই এই নিরানন্দ দর্শনে এসে পৌঁছেন। ক্রুচ বাস করেছিলেন নিউইয়র্কের সুখভোগী ইন্টেলেকচুয়ালদের মধ্যে। বাইন সঁতরে ছিলেন ভোগের নদী। ইকলেজিয়েটসের রচয়িতাও ভোগের ব্যাপারে কম যাননি। সুরা, সঙ্গীত ও অনুরূপ অন্যান্য ব্যাপারে তার জুড়ি ছিল না বললেই চলে। দাস-দাসী ছিল তার বিস্তর, সরোবরও তিনি খনন করিয়েছিলেন। ভোগের আয়োজনে কোনোকিছুই তিনি বাকি রাখেননি! তথাপি তিনি দেখতে পেলেন সকলই ফাঁকি, মায়া–এমনকি জ্ঞানও।
আর আমি জ্ঞান-আহরণে মনোনিবেশ করলুম, নির্বোধ মমতায় জীবনের স্বাদও নিলুম। কিন্তু ততঃ কিম? তাতে তো আত্মার বিক্ষোভই বাড়ে, কমে না। কারণ যতবেশি জ্ঞান বাড়ে, ততবেশি দুঃখও বাড়ে। জ্ঞান বাড়িয়ে তুমি দুঃখই বাড়াও।