- বইয়ের নামঃ ক্রেনিয়াল
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ তাম্রলিপি
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. টিশা বড় একটা কংক্রিটের টুকরোর উপর দাঁড়িয়ে
ক্রেনিয়াল – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৬
.
উৎসর্গ
ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তার ভূমিকার কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
.
০১.
টিশা বড় একটা কংক্রিটের টুকরোর উপর দাঁড়িয়ে বহুদূরে তাকিয়ে থেকে অনেকটা নিজের মনে গুনগুন করে একটা গান গাইছিল। তার গানের গলা অপূর্ব, কিন্তু এখানে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি খুবই বিপজ্জনক, মনে হচ্ছিল যে কোনো মুহূর্তে বুঝি পড়ে যাবে। গান গাইতে গাইতে দূরে তাকিয়ে সে কী দেখছে কে জানে। দেখার কিছু নেই, যতদূর চোখ যায় শুধু লালচে মাটি, পাথর আর উঁচু-নিচু হয়ে থাকা বালিয়াড়ি। টিশা হঠাৎ করে গানটি শেষ করে ফেলল, তখন আমি বললাম, “টিশা সাবধান, পড়ে যাবে কিন্তু!”
আমার কথা শুনে টিশা মনে হয় একটু মজা পেল। তাই আমাকে ভয় দেখানোর জন্য সে বিপজ্জনক ভঙ্গিতেই পাশের কংক্রিটের টুকরোর উপর একটা লাফ দিল। আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম, মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে বুঝি তাল হারিয়ে পড়ে যাবে। টিশা অবশ্যি পড়ে গেল না, নিজেকে সামলে নিয়ে আবার একটা বিপজ্জনক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে। আমি একটু বিস্ময় নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকি, তাকে আমি সেই ছেলেবেলা থেকে চিনি, কিন্তু সে যখন এভাবে খিলখিল করে সারা শরীর দুলিয়ে হাসে তখন হঠাৎ করে মনে হয় সে বুঝি টিশা নয়, সে বুঝি অচেনা একটি মেয়ে।
টিশা হাসি থামিয়ে বলল, “তুমি এরকম হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?”
টিশার কথা শুনে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম কিন্তু সেটা বুঝতে দিলাম না, বললাম, “আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখার জন্য তুমি কখন পড়ে যাও–তখন আমার নিচে গিয়ে তোমার শরীরটাকে ঘাড়ে করে টেনে তুলে আনতে হবে।”
টিশা চোখ নাচিয়ে বলল, “তোমার কোনো ভয় নেই রিহি। আমি পড়ে যাব না।”
আমি সাবধানে একটা কংক্রিটের টুকরো থেকে আরেকটা টুকরোয় পা দিয়ে টিশার কাছে এসে দাঁড়ালাম। বাতাসে তার চুল উড়ছে, আমি সেই চুলের মৃদু ঘ্রাণ পেলাম। টিশা হাত তুলে দূরে দেখিয়ে বলল, “আমার সব সময় জানার ইচ্ছা করে ওইখানে কী আছে?”
“কোনখানে?”
টিশা অনির্দিষ্টের মতো হাত নেড়ে বলল, “ওই তো। ওই দূরে।”
আমি বললাম, “কী থাকবে। কিছু নেই। বহুদূরে হয়তো মানুষের আস্তানা আছে। সেখানে আমাদের মতো মানুষ থাকে।”
টিশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার খুব জানার ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে আমার কী ইচ্ছা করে জান?”
“কী?”
“একটা মোটর বাইকে করে বাইরে ঘুরে বেড়াই। দেখি কোথায় কী আছে?”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “বল কী তুমি? বাইরে ঘুরে বেড়াবে? তুমি জান না বাইরে দস্যু গিজগিজ করছে। মাটিতে রেডিয়েশান। জন্তু-জানোয়ারের মিউটেশান হয়ে দানব হয়ে গেছে।”
টিশা বলল, “জানি।”
“তাহলে?”
“আমি সব জানি, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “বিশ্বাস কর না?”
টিশা মাথা নাড়ল, “নাহ্।” আমি প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললাম, “তুমি জান, তুমি এইসব কথা বলছ জানলে তোমাকে কী করবে?”
“জানি। আমাকে ডিটিউন করে দেবে। আমি তখন কিছু বুঝব। আমাকে যেটা বলবে সেটা করব। আমাকে দিয়ে শহরের রাস্তা পরিষ্কার করাবে। ময়লা টেনে নেওয়াবে। আরও খারাপ খারাপ জিনিস করাবে।”
“তাহলে?”
টিশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে কী?”
“তাহলে এরকম কথা বলছ কেন?”
টিশা হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, “আমি কি কমিউনে বক্তৃতা দিয়ে বলছি? আমি শহরের প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে তোমাকে বলছি।” টিশা আমার বুকে ঠোকা দিয়ে বলল, “রিহিকে! তুমি কি আমার বিরুদ্ধে নালিশ করবে?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না। আমি করব না।”
“তাহলে সমস্যা কী?”
“আমাকে বললে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু এরকম আজগুবি কথা বলার দরকার কী?”
টিশা কোনো কথা বলল না, ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আমি বললাম, “তাকিয়ে দেখো, আমাদের পুরো শহরটাকে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কংক্রিটের টুকরো ফেলে ফেলে প্রাচীরটা তৈরি করেছে। কত উঁচু প্রাচীর দেখেছ?”
টিশা নিচে তাকাল, তারপর বলল, “দেখেছি।”
“বাইরে যদি বিপদ না থাকবে তাহলে প্রাচীর দিয়ে শহরটাকে ঘিরে রাখবে কেন?”
টিশা বলল, “আমি তো কোনো বিপদ দেখি না।”
আমি বড়মানুষের মতো ভঙ্গি করে বললাম, “তুমি দেখ না মানে এই নয় যে বিপদ নেই। আছে, নিশ্চয়ই আছে।”
টিশা হঠাৎ করে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের শহরের মাঝে বিপদ নেই?”
“শহরের মাঝে?”
“হ্যাঁ, শহরের মাঝে? এই বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা শহরের মাঝে কোনো বিপদ নেই?”
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “কিসের বিপদ? আমরা তো শহরে বেশ নিরাপদেই আছি।”
টিশা মুখ শক্ত করে বলল, “কুনিলের কথা মনে আছে? কুনিল কত হাসিখুশি ছেলে ছিল মনে আছে?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “মনে আছে।”
“আর এখন? কুনিলকে ডিটিউন করে দিয়েছে। সকাল থেকে রাত রোদবৃষ্টিতে রাস্তা পরিষ্কার করে। আমরা যখন পাশ দিয়ে হাঁটি আমাদের দিকে তাকায় না। যখন আমাদের দিকে তাকায় আমাদের চেনে না।” হঠাৎ করে টিশার গলাটা ভেঙে গেল, “কী দোষ ছিল কুনিলের?”