- বইয়ের নামঃ ওমিক্রনিক রূপান্তর
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. আহাম্মক
রিকির জন্যে অপেক্ষা না করেই বিজ্ঞান আকাদেমির অধিবেশন শুরু হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম অপেক্ষা করা হত, আজকাল আর করা হয় না। সে অনেক দিন হল এইসব অধিবেশনে যোগ দেয়া ছেড়ে দিয়েছে। তাই আজ হঠাৎ করে যখন অধিবেশনের মাঝখানে রিকি এসে হাজির হল, সবাই একটু অবাক না হয়ে পারল না। রিকি সবার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তার স্বভাবসুলভ উদ্ধত ভঙ্গিতে নিজের আসনে গিয়ে বসে। শব্দ করে তার হাতের ব্যাগ থেকে একটা ছোট পানীয়ের শিশি বের করে এক ঢোক খেয়ে শিশিটা টেবিলের উপর রাখে।
বৃদ্ধ সভাপতি রু সচরাচর রিকির উদ্ধত আচার-আচরণকে সযত্নে এড়িয়ে যান, সবাই ভেবেছিল আজও তাই করবেন। কিন্তু রু কী কারণে জানি টেবিলে তাঁর কাগজপত্র ভাঁজ করে রেখে শান্ত গলায় বললেন, রিকি, তুমি তিরিশ মিনিট দেরি করে এসেছ।
রিকি মুখে একটু হাসি টেনে আনার ভান করে বলল, জানি।
সে ক্ষেত্রে তোমার অধিবেশনে যোগ দেয়ার আগে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন আছে।
তাই নাকি? রিকি গলার স্বরে ব্যঙ্গটুকু আড়াল করার কোনো চেষ্টা করল না।
এসব নিয়মকানুন বেশিরভাগই স্বাভাবিক ভদ্রতা, তুমি জান না এতে আমি খুব অবাক হই না। রু হঠাৎ অত্যন্ত কঠিন স্বরে বললেন, তোমার অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন আছে রিকি।
রিকি কিংবা অন্য কেউই মহামান্য রুকে এ রকম কঠিন স্বরে কথা বলতে দেখে নি। মুহূর্তের মাঝে পরিবেশটি আশ্চর্য রকম শীতল হয়ে যায়।
রিকি একটু বিপন্ন অনুভব করে, কষ্ট করে নিজের গলার স্বরকে স্বাভাবিক রেখে বলল, ঠিক আছে, অনুমতি নিচ্ছি।
নাও।
আমি কি অধিবেশনে যোগ দিতে পারি?
রু তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, না।
ঘরে বজ্ৰপাত হলেও মনে হয় কেউ এত অবাক হত না। বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা এত প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী যে পৃথিবীর শাসনতন্ত্র পর্যন্ত তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রিকির ফর্সা মুখ অপমানে টকটকে লাল হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, আপনি আমাকে সবার সামনে অপমান করার চেষ্টা করছেন।
না।
তাহলে? বিজ্ঞান আকাদেমির তোমাকে আর প্রয়োজন নেই। তোমাকে এই ছোট একটি সত্যি কথা জানানোর চেষ্টা করছি।
সেই সত্যি কথাটি কার মাথা থেকে বের হয়েছে?
আমার।
আপনাকে কে এই ক্ষমতা দিয়েছে?
কেউ দেয় নি। রু আস্তে আস্তে বললেন, আমি নিজেই নিয়েছি।
বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যদের ক্ষমতা প্রায় ঈশ্বরের মতো। তাদেরকে আদেশ দেওয়া যায় না।
হ্যাঁ, তাদের ক্ষমতা দিয়েছে পৃথিবীর সাধারণ মানুষ। তারা যখন দেখবে সেই ক্ষমতা অপব্যবহার করা হচ্ছে, সে-ক্ষমতা তারা আবার নিয়ে নেবে। তুমি তোমার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছ রিকি।
কী করেছি আমি?
অনেক কিছু করেছ। সবচেয়ে দুঃখজনক হল তোমার স্ত্রীর মৃত্যু। তুমি তাঁকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছ রিকি।
রিকি চমকে উঠে বৃদ্ধ রুয়ের মুখের দিকে তাকাল। রু শান্ত গলায় বললেন, সাধারণ মানুষ হলে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা সব নিয়মকানুনের উর্ধ্বে, তাই তোমাকে স্পর্শ করা হয় নি।
রিকি কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি কে। আমি হচ্ছি সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আনাহাসু রিকিশান, সংক্ষেপে রিকি। চোদ্দ বৎসর বয়সে আমি মহাজাগতিক সূত্রের সপ্তম সমাধান করেছি। সতের বৎসর বয়সে আমার নামে তিনটি ইনস্টিটিউট খোলা হয়েছে। বাইশ বছর বয়সে আমি বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্য হয়েছি, সময়সূত্রের একমাত্র সমাধানটি আমার নিজের হাতে করা, নবম সূত্রের রিকি পরিভাষা ব্যবহারিক অঙ্কের জন্যে নূতন জগতের সন্ধান দিয়েছে—
রু হাত তুলে তাকে থামালেন, বললেন, আমরা জানি তুমি অত্যন্ত প্রতিভাবান বিজ্ঞানী।
আমার জন্য পৃথিবীর সাধারণ নিয়ম খাটে না মহামান্য রু। পৃথিবীর দুই-চারটি সাধারণ মানুষের প্রাণ আমার ব্যক্তিগত খেয়াল থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার স্ত্রী অত্যন্ত নির্বোধ মহিলা ছিল।
আমি মৃতদের নিয়ে অসম্মানজনক কথা পছন্দ করি না, রিকি।
রিকি থতমত খেয়ে থেমে যায়, আস্তে আস্তে তার মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসে। টেবিল থেকে পানীয়ের শিশিটি তুলে এক ঢোক খেয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বলল, ঠিক আছে, তা হলে জীবিত ব্যক্তিদের কথাই বলি। এই বিজ্ঞান আকাদেমি হচ্ছে একটা গণ্ডমূর্খের আড়া। এখানকার সবাই হচ্ছে একজন করে নির্বোধ। বিজ্ঞানের সবগুলো শাখায় আমি একা যে পরিমাণ অবদান রেখেছি, আপনারা সবাই মিলে তার এক শ ভাগের এক ভাগ অবদান রাখেন নি।
সেটা নির্ভর করে তুমি অবদান বলতে কী বোঝাও তার উপর। রিকি, তুমি ভুলে যাচ্ছ, বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যদের ব্যক্তিগত গবেষণার সময় কিংবা সুযোগ নেই।
আমাকে সেটা বিশ্বাস করতে বলছেন?
রু কোমল গলায় প্রায় হাসিমুখে বললেন, সেটা তোমার ইচ্ছে রিকি। কিন্তু তুমি যেহেতু বিষয়টি তুলেছ, তোমাকে একটা ঘটনার কথা বলি। প্রায় কুড়ি বছর আগে পশ্চিমের পাহাড়ী অঞ্চলের একটা কৃষিজীবী এলাকার বাচ্চাদের স্কুল থেকে আমি একটা চিঠি পেয়েছিলাম। স্কুলের একজন শিক্ষকের চিঠি—অনেক ঘুরে আমার কাছে এসেছিল। চিঠিতে শিক্ষক লিখেছেন, তাঁর ক্লাসে নাকি একজন অস্বাভাবিক প্রতিভাবান শিশু রয়েছে। আমি শিশুটির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার বয়স তখন সাত, সে ছয় বৎসর বয়সে মহাজাগতিক সূত্রের প্রথম সমাধানটি করেছিল। সাত বৎসর বয়সে সে সময়ে পরিভ্রমণের উপর প্রায় সঠিক একটা সূত্র দিয়েছিল। আমি তাকে এবং তার পরিবারকে রাজধানীতে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। বাচ্চাটি রাজি হয় নি। সে বিজ্ঞানে উৎসাহী নয়।