- বইয়ের নামঃ বৃষ্টির ঠিকানা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. মিসেস হেনরিকসন
জ্যামিতি ক্লাশটাকে টুম্পার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে। ক্লাশটা পড়ান মি. কিনবারো, তবে ক্লাশের সবাই তাকে ডাকে মি, ক্যাঙ্গারু। সত্যি সত্যি মি. কিনবারোর মাঝে একটা ক্যাঙ্গারু ক্যাঙ্গারু ভাব আছে–মানুষটা কেমন জানি লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটেন। ক্লাশের ভেতর কথা বলতে বলতে তাঁদের কান একেবারে ঝালাপালা করে দেন কিন্তু কী নিয়ে কথা বলেন তারা কেউ কিছু বোঝেনা। মি. ক্যাঙ্গারুর গুরু হচ্ছেন ইউক্লিড, ক্লাশে কথায় কথায় ইউক্লিডের উদাহরণ দেন আর প্রত্যেকবার ইউক্লিডের নাম উচ্চারণ করার সময় তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়, গলা কাঁপতে থাকে আর তাকে দেখে মনে হয় এক্ষুণি বুঝি হাঁটু ভাঁজ করে মাটিতে শুয়ে একটা সালাম করে দেবেন। টুম্পার যা হাসি পায় সেটা আর বলার মতো নয় কিন্তু এত কিছুর পরেও মি, ক্যাঙ্গারুর ক্লাশের মাঝে কোনো রস কস নেই। এক ঘন্টার ক্লাশটাকে মনে হয় এক বছর লম্বা, সারাক্ষণ টুম্পার চোখ ঘুরে ঘুরে দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে চলে যায় সে অপেক্ষা করতে থাকে কখন মিনিটের কাঁটা নয়ের মাঝে পৌঁছাবে আর পি.এ. সিস্টেম থেকে ক্লাশ শেষ হওয়ায় মধুর একটা বেলের শব্দ ভেসে আসবে।
মি. ক্যাঙ্গারু খুব সময় মেনে চলার চেষ্টা করেন। ক্লাশের সবাই দেখেছে মানুষটা ক্লাশ শুরু হবার দুই এক মিনিট আগে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। মিনিট আর সেকেন্ডের কাঁটাটা ঠিক যখন বারোটার ওপর হাজির হয় তখন মি, ক্যাঙ্গারু দড়াম করে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে নাটকীয়ভাবে বলেন, গুড মর্নিং মাই ডিয়ার স্টুডেন্টস! এমন হাস্যকর ব্যাপার যে সেটা বলার মতো নয়।
আজকে অবশ্য অন্য ব্যাপার, সময় অনেকক্ষণ আগে পার হয়ে গেছে এখনো মি, ক্যাঙ্গারুর দেখা নেই, নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে। যে মানুষ কখনো এক সেকেন্ড দেরী করে না তার জন্যে পাকা দশ মিনিট দেরি করা সোজা কথা নয়–প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। ক্লাশের ছেলেমেয়েরা একটু অস্থির হয়ে উঠছে, কেভিন কাগজ দিয়ে প্লেন তৈরী করে এদিক–সেদিক ছুড়ে মারতে শুরু করেছে। জেসিকা চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে কোমর দুলিয়ে গান গাওয়ার ভঙ্গী করছে তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে মাইকেল আর জিম অদৃশ্য একটা গিটার বাজাচ্ছে। পিটার একটা রাবার ব্যান্ডের মাঝে কাগজের ছোট ছোট গুটলি লাগিয়ে আশেপাশের ছেলেমেয়েদের নাক নিশানা করে টার্গেট প্র্যাকটিস করার চেষ্টা করছে।
এইভাবে যখন আরও পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে তখন মোটামুটি সবাই বুঝে গেল আজ কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, ক্লাশে মি. ক্যাঙ্গারু বা অন্য কেউই আসবে না। তারা হৈ হৈ করে যখন বইপত্র তুলে ক্লাশ থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে দাঁড়ালো ঠিক তখন দরজা খুলে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলার মাথা ক্লাশের মাঝে উঁকি দেয়। মাথায় কাঁচা–পাকা চুল, চোখে সোনালি রঙের একটা চশমা। কেউ যে পকেটের পয়সা খরচ করে এরকম পুরানো মডেলের একটা চশমা কিনতে পারে টুম্পা নিজের চোখে না দেখলে সেটা বিশ্বাস করতো না। চশমাটা নিশ্চয়ই এই মহিলার খুব প্রিয় চশমা কারণ সেটা কটকটে হলুদ রঙের একটা স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা যেন নাকের ডগা থেকে লাফ দিয়ে সেটা বের হয়ে চলে যেতে না পারে! মহিলাটি ক্লাশের ভেতরে এক নজর দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে ভেতরে ঢুকলেন। তাকে দেখে সবাই বুঝে গেল আজকে মি. ক্যাঙ্গারু আসছেন না তার বদলে এই মহিলা হবেন তাদের সাবস্টিটিউট টিচার। সাবস্টিটিউট টিচার মানেই হচ্ছে সময় নষ্ট তাই সবাই নাকের ভেতর দিয়ে ফোঁস করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেদের চেয়ার টেবিলে বসতে শুরু করলো।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি ক্লাশের ভেতরে ঢুকে টেবিলের উপর তার হাতের কাগজগুলো রেখে সবাইকে নিজের চেয়ার টেবিলে বসে যাবার সময় দিলেন তারপর সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলেন। মানুষ নার্ভাস হলে সবসময় একটু হাসার চেষ্টা করে কিন্তু এই মহিলাকে একটুও নার্ভাস মনে হলো না।
মহিলাটি চশমার ওপর দিয়ে ক্লাশের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ক্রিস্টিনা হেনরিকসন। তোমরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছো আমি তোমাদের সাবস্টিটিউট টিচার।
ক্লাশের ছেলেমেয়েরা কেউ জোরে কেউ আস্তে মাথা নাড়ল, কেউ গলা দিয়ে কেউ নাক দিয়ে একরকম শব্দ বের করল। তবে সবার চোখে মুখেই এক ধরনের হাল ছেড়ে দেবার মতো ভাবভঙ্গী। মি. ক্যাঙ্গারু তাদের নিয়মিত টিচার তার ক্লাশেই সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় আর সোনালি রঙের চশমা পরা এই সাবস্টিটিউট টিচারের ক্লাশে কী হবে সেটা আন্দাজ করা মোটেই কঠিন নয়। মিসেস হেনরিকসন পুরো ক্লাশের দিকে এক নজর তাকিয়ে বললেন, মজাটা কী হয়েছে শোনো–
মজার কথা শুনে ক্লাশের সবাই অবশ্যি নড়েচড়ে বসে মিসেস হেনরিকসনের দিকে তাকালো। মিসেস হেনরিকসন বললেন, আজকে তোমাদের দরকার একজন জ্যামিতির টিচার কিন্তু আমি হচ্ছি ভূগোলের টিচার।
এর ভেতরে মজার বিষয়টা কী কেউ ধরতে পারল না। একজন ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, তাহলে তোমাকে এনেছে কেন?