- বইয়ের নামঃ হিমুর রূপালী রাত্রি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, দর্শন
ফাতেমা খালার চিরকুট
ফাতেমা খালা একটা চিরকুট পাঠিয়েছেন। চিরকুটে লেখা—
হিমু,
এক্ষুনি চলে আয়, ম্যানেজারকে পাঠালাম। খবৰ্দার দেরি করবি না।
খুবই জরুরী। Very urgent.
ইতি
ফাতেমা খালা।
ম্যানেজার ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তার গায়ে স্যুট। পায়ে কালো রঙের জুতা। মনে হয় আসার আগে পালিশ করিয়ে এনেছেন। জুতা জোড়া আয়নার মত চকচক করছে। গলায় সবুজ রঙের টাই। বেশির ভাগ মানুষকেই টাই মানায় না। ইনাকে মানিয়েছে। মনে হচ্ছে ইনার গলাটা তৈরিই হয়েছে টাই পরার জন্যে। ভদ্রলোক আফটার শেভ লোশন, কিংবা সেন্ট মেখেছেন। মিষ্টি গন্ধ আসছে। তার চেহারাও সুন্দর। ভরাট মুখ। ঝকঝকে শাদা দাঁত। বিদেশী টুথপেষ্টের বিজ্ঞাপনে এই দাঁত ব্যবহার করা যেতে পারে। ভদ্রলোককে ফাতেমা খালার ম্যানেজার বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোন মান্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। বোঝাই যাচ্ছে, আমার ঘরটা তাঁর খুবই অপছন্দ হচ্ছে। তিনি সম্ভবত কোন বিকট দুৰ্গন্ধ পাচ্ছেন। কারণ কিছুক্ষণ পরপরই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে নিঃশ্বাস টানছেন। পকেটে হাত দিচ্ছেন, সম্ভবত রুমালের খোঁজে। তবে ভদ্রতার খাতিরে রুমাল দিয়ে নাকচাপা দিচ্ছেন না। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। সম্ভবত দুৰ্গন্ধ কোথেকে আসছে তা বের করার চেষ্টা।
ভদ্রলোক অস্থির গলায় বললেন, বসে আছেন কেন? চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, কোথায় চলব?
গাড়ি নিয়ে এসেছি।
দেরি হবে। হাত-মুখ ধোবা, চা-নাশতা করব।
চা-নাশতা ম্যাডামের বাসায় করবেন। চট করে মুখটা শুধু ধুয়ে নিন।
মুখ ধুতেও দেরি হবে। ঘন্টা দুই লাগবে।
আমি আবারো হাই তুলতে তুলতে (এবারের হাইটা নকল হাই) বললাম, বেশিও লগতে পারে। আমাদের এই মেসে একটা মোটে বাথরুম। ত্ৰিশজন বোর্ডার। ত্ৰিশজন বোর্ডারের সঙ্গে সব সময় থাকে গোটা দশেক আত্মীয়, কিছু দেশের বাড়ির মানুষ। সব মিলিয়ে গড়ে চল্লিশজন। এই চল্লিশজনের সঙ্গে আমাকে লাইনে দাঁড়াতে হবে। সকালবেলার দিকে লম্বা লাইন হয়।
দুঘন্টা অপেক্ষা করা সম্ভব না। আপনি গাড়িতে উঠুন। হাত-মুখ আপনার খালার বাড়িতে ধুবেন। সেখানকার ব্যবস্থা অনেক ভাল।
ভদ্রলোকের গলায় এখন হুকুমের সুর বের হচ্ছে। স্যুট-টাই পরা মানুষ অবশ্যি নরম স্বরে কথা বলতে পারে না। আপনাতেই তাদের গলার স্বরে একটা ধমকের ভাব চলে আসে। অবশ্যি স্যুট পরা মানুষ মিনমিন করে কথা বললে শুনতেও ভাল লাগে না। তাদেরকে ঘরজামাই মনে হয়। শ্বশুরবাড়ির সুটে পার্সোনিলিটি আসে না। একি এখনো বসে আছেন? বললাম না, চলুন।
আমি চৌকি থেকে নামতে নামতে বললাম, আজ কি বার?
মঙ্গলবার।
আমি আবারো ধাপ করে চৌকিতে বসে পড়লাম। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললাম, মঙ্গলবার যদি হয়, তাহলে যাওয়া যাবে না। মঙ্গলবার যাত্রা নাস্তি।
যাবেন না?
জ্বি না। আপনি বরং বুধবারে আসুন।
বুধবারে আসব?
জ্বি। খনার বচনে আছে — বুধের ঘাড়ে দিয়ে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা।
ম্যানেজার চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে খনার বচন শোনা তাঁর অভ্যাস নেই। তিনি মনে হয় খানিকটা রেগেও যাচ্ছেন। চোখ ছোট ছোট হয়ে গেছে। রাগলে মানুষের চোখ ছোট হয়ে যায়। আনন্দিত মানুষের চোখ হয় বড় বড়।
হিমু সাহেব।
জ্বি।
আপনাকে যেতেই হবে। ম্যাডাম আমাকে পাঠিয়েছেন, আপনাকে নিয়ে তে। আমি না নিয়ে যাব না। আপনি লাইনে দাঁড়িয়ে হাত-মুখ ধোন, চা-নাশতা খান, ইচ্ছে করলে আরো খানিকক্ষণ গড়াগড়ি করুন। আমি বসছি। দুঘন্টা কেন দরকার হলে সাত ঘন্টা বসে থাকব। কিছু মনে করবেন না, নাশত কি নিজেই বানাবেন?
জ্বি না। ছক্কু দিয়ে যাবে।
ছক্কুটা কে?
ছক্কু নাশতা কখন দিয়ে যাবে? হাত-মুখ ধুয়ে এসে উত্তর দিকের এই জানালাটা খুলে দেব। এটাই হল আমার সিগন্যােল। বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্ট থেকে আমার ঘরের জানালা দেখা যায়। ছক্কু আমার ঘরের জানোলা খোলা দেখে বুঝবে আমি হাত-মুখ ধুয়ে ফেলেছি। সে নাশতা নিয়ে চলে অ্যাসবে। পরোটা-ভাজি।
কিছু মনে করবেন না, আমি এখনই জানালাটা খুলে দি। আপনার হয়ে সিগন্যাল দিয়ে দি। নাশতা চলে আসুক। নয়ত নাশতার জন্যে আবার এক ঘন্টা বসতে হবে।
আগেভাগে জানালা খোলা ঠিক হবে না। আমার ঘরটা নর্দমার পাশে তো— বিকট গন্ধ আসবে। আপনি নতুন মানুষ। আপনার অসুবিধা হবে। শুধু রুমালে কাজ হবে না। গ্যাস মাস্ক পরতে হবে।
ভদ্রলোক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কিছু কিছু মানুষ আছে — সহজে বিস্মিত হয় না। তারা যখন বিস্মিত হয় তখন দেখতে ভাল লাগে। এই ভদ্রলোক মনে হচ্ছে সেই দলের। তার বিস্মিত দৃষ্টি দেখতে ভাল লাগছে। তাকে আরো খানিকটা ভড়কে দিলে কেমন হয়?
ম্যানেজার সাহেব! আপনার নাম কি?
রকিব রকিবুল ইসলাম।
আপনি ভাল আছেন?
রকিবুল ইসলাম জবাব দিলেন না। সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বোধহয় তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান না।
ফাতেমা খালার ম্যানেজারী কতদিন হল করছেন?
বেশিদিন না, দুমাস।
খালার অবস্থা কি? তার মাথা কি পুরোপুরি আউলা হয়ে গেছে— না এখনো কিছু বাকি আছে?