- বইয়ের নামঃ হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D. বল্টুভাই
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D. বল্টুভাই
অন্যকথা
আমার কিছু পাঠক আছেন, যারা হিমু-বিষয়ক রচনাগুলি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন। এই উপন্যাসটির ক্ষেত্রে তারা যেন সে রকম কিছু না ভাবেন। এখানে গল্পকার হিসাবে আমি নেহায়েতই এক গল্প ফেঁদেছি। ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় যাই নি। সেরকম ইচ্ছা হলে আমি জটিল প্ৰবন্ধই লিখব। হিমু রচনায় হাত দেব না।
হিমু বিষয়ক প্রতিটি লেখাতেই আমি এই ভুবনের রহস্যময়তার দিকে ইঙ্গিত করেছি। এর বেশি কিছু না। আমি নিজে জগতের রহস্যময়তা দেখে প্রতিনিয়ত অভিভূত হই। আমি চাই, আমার পাঠকরাও অভিভূত হোক।
হুমায়ূন আহমেদ
জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক
০১.
হার্ভার্ডের Ph.D. দেখেছিস?—বলেই মাজেদা খালা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইলেন। যেন তিনি কঠিন এক ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছেন, যার উত্তর তিনি ছাড়া কেউ জানে না। তাকে একই সঙ্গে আনন্দিত এবং উত্তেজিত মনে হচ্ছে। কপালে উত্তেজনার বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঠোঁটের কোণে আনন্দের চাপা হাসি। খালা তাঁর গোল চোখ আমার দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে এনে গলা নামিয়ে বললেন, এই হাদারাম! হার্ভার্ডের ফিজিক্সের Ph.D. দেখেছিস কখনো?
আমি বললাম, না। দেখতে ভয়ঙ্কর?
খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, ভয়ঙ্কর হবে কেন? অন্যরকম।
অন্যরকমটা কী?
সারা গা থেকে জ্ঞানের আভা বের হওয়ার মতো অন্যরকম।
বলো কী!
বড় বড় দিশেহারা চোখ। দেখলেই এমন মায়া লাগে।
আমি বললাম, চোখ দিশেহারা কেন?
খালা বললেন, ফিজিক্সের জটিল সমুদ্রে পড়েছে, এইজন্যে দিশেহারা। এখন সে কাজ করছে ঈশ্বর-কণা’ নিয়ে। যতই সে পড়ছে, ততই দিশেহারা হচ্ছে। আহা বেচারা! ঈশ্বর-কণার নাম শুনেছিস কখনো?
না। ঈশ্বর যে কণা হিসেবে পাওয়া যায় তা-ই জানতাম না।
খালা বললেন, আমিও জানতাম না। বাংলাদেশে কেউ মনে হয় জানে না।
আমি বললাম, বাংলাদেশ বাদ দাও, ঈশ্বর নিজেও হয়তো জানেন না যে তাঁকে কণা হিসেবে পাওয়া যায়।
খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, ঈশ্বর জানবেন না এটা কেমন কথা! উনি সবই জানেন।
হার্ভার্ড সাহেবকে চেনো কীভাবে?
সে তোর খালু সাহেবের বন্ধুর ছেলে।
Ph.D. সাহেবের নাম কী?
ডক্টর আখলাকুর রহমান চৌধুরী। ভুল বলেছি, চৌধুরী আগে হবে। ডক্টর চৌধুরী আখলাকুর রহমান। ফুল প্রফেসর অব থিওরেটিকেল ফিজিক্স। ভেনডারবেল্ট ইউনিভার্সিটি।
ডাকনাম কী?
ডাকনাম দিয়ে কী করবি?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, যারা জটিল অবস্থানে থাকে তাদের ডাকনাম খুব হাস্যকর হয়। দেখা যাবে উনার ডাকনাম বল্টু।
বল্টু?
হ্যাঁ বল্টু। পেরেকও হতে পারে। আবার গোল্লা-ফোল্লাও হওয়া বিচিত্র না।
খালা বিরক্ত গলায় বললেন, যতই দিন যাচ্ছে তোর কথাবার্তা ততই অসহ্য হয়ে যাচ্ছে। চা-কফি কিছু খাবি?
খাব ৷
কী দেব, চা না কফি?
দুটাই দাও। এক চুমুক চা খেয়ে এক চুমুক কফি খাব। ডাবল অ্যাকশন। হার্ভার্ড Ph.D.-র কথা শুনে ঝিম ধরে গেছে। ডাবল অ্যাকশন ছাড়া গতি নেই। ইউরোপ-আমেরিকা হলে বলতাম, নিট দুই পেগ হুইঙ্কি দাও, অন দ্যা রক।
খালা বললেন, আমি যে তোর মুরুকিব, গুরুজন, এটা মনে থাকে না? লাগামছাড়া কথাবার্তা।
খালা হয়তো আরও কিছু কঠিন কথা বলতেন, তার আগেই মোবাইল ফোন বাজল। তিনি ফোন নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। মোবাইল ফোনের নিয়ম হচ্ছে-এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। হাঁটাহাঁটি করে কথা বলতে হয়।
মিনিট তিনেক পার করে খালা উদয় হলেন। এখন তাকে পদার্থবিদ সাহেবের মতো খানিকটা দিশেহারা দেখাচ্ছে। মুখের ভঙ্গি কাচুমাচু। আমি বললাম, খালা, কোনো সমস্যা?
খালা নিচু গলায় বললেন, ও টেলিফোন করেছিল। ওর ডাকনাম সত্যিই বল্টু। ওরা দুই যমজ ভাই। একজনের নাম নাট, আরেকজনের নাম বল্টু। একসঙ্গে নাট-বল্টু। ওদের বাবা ছিল পাগলাটাইপের। এইজন্যে নাট-বল্টু নাম রেখেছে। কী বিশ্রী কাণ্ড!
তুমি মন খারাপ করছি কেন? বল্টু নাম তো খারাপ কিছু না। ডক্টর বল্টুশুনতেও ভালো লাগছে। নাট-বল্টু দুই ভাইকে নিয়ে সুন্দর ছড়াও হয়—
নাট বল্টু দুই ভাই
রিকশা চড়ে, দেখতে পাই।
রিকশা যায় মতিঝিল
বল্টু হাসে খিলখিল।
নাটের মুখ বন্ধ
তার গায়ে গন্ধ।
খালা কঠিন গলায় বললেন, চুপ কর। মুখ বন্ধ।
আমি মুখ বন্ধ করলাম। খালা বললেন, বল্টু উঠেছে সোনারগাঁও হোটেলে। রুম নম্বর চার শ’ একুশ। তোকে খবর দিয়ে এনেছি—বল্টুকে কিছু জিনিস দিয়ে আসবি।
আমি বললাম, সহজ নামের মাহাত্ম্য দেখলে? তুমি নিজেও এখন সমানে বল্টু ডাকছ! বল্টুভাইকে এখন আর দূরের কেউ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ঘরের মানুষ। সে এমন একজন যে দুই চান্সে ইন্টার’ পাস করেছে। অনেক চেষ্টা করেও কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারে নি। তার এখন প্রধান কাজ মেয়ে-স্কুলের গেটের সামনে হাঁটাহঁটি করা। ফ্লাইং কিস দেওয়া।
তুই কি চুপ করবি? নাকি একটা থাপ্পড় দিয়ে মুখ বন্ধ করব?
চুপ করলাম।
খালা বললেন, ও লুঙ্গি-গামছা আর একটা বাংলা ডিকশনারি চেয়েছে। সব আনিয়ে রেখেছি। তুই দিয়ে আয়।
নো প্রবলেম। লুঙ্গি, বাংলা ডিকশনারি বুঝলাম। গামছা কেন? কাদের সিদ্দিকীর দলে জয়েন করার পরিকল্পনা কি আছে?