- বইয়ের নামঃ রসমঞ্জরী
- লেখকের নামঃ ভারতচন্দ্র রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০০. ভূমিকা (রসমঞ্জরী)
জয় জয় রাধা শ্যাম : নিত্য নব রসধাম : নিরুপম নায়িকানায়ক।
সর্ব্বসুলক্ষণধারী : সর্ব্বরসবশকারী : সর্ব্ব প্রতি প্রণয়কারক।।
বীণা বেণু যন্ত্র গানে : রাগরাগিনীর তালে : বৃন্দাবনে নাটিকানাটক।
গোপগোপীগণ সঙ্গে : সদা রাস রসরঙ্গে : ভারতের ভক্তিপ্রদায়ক।।
রাঢ়ীয় কেশরী গ্রামী : গোষ্ঠীপতি দ্বিজস্বামী : তপস্বী শাণ্ডিল্য শুদ্ধাচার।
রাজঋষি গুণযুত : রাজা রঘুরামসুত : কলিকালে কৃষ্ণ অবতার।।
কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজ : সুরেন্দ্র ধরণীমাঝ : কৃষ্ণনগরেতে রাজধানী।
সিন্ধু অগ্নি রাহুমুখে : শশী ঝাঁপ দেয় দুঃখে : যার যশে হয় অভিমানী।।
তার পরিজন নিজ : ফুলের মুখটী দ্বিজ : ভরদ্বাজ ভারত ব্রাহ্মণ।
ভুরিশিট রাজ্যবাসী : নানাকাব্য অভিলাষী : যে বংশে প্রতাপ নারায়ণ।।
রাজবল্লভে কার্য্য : কীর্ত্তিচন্দ্র নিজরাজ্য : মহারাজা রাখিলা স্থাপিয়া।
রসমঞ্জরীর রস : ভাষায় করিতে বশ : আজ্ঞা দিলা রসে মিশাইয়া।।
সেই আজ্ঞা অনুসারি : গ্রন্থারম্ভে ভয় করি : ছল ধরে পাছে খল জন।
রসিক পণ্ডিত যত : যদি দেখ দুষ্ট মত : সারি দিবা এই নিবেদন।।
০১. নায়িকা প্রকরণ
শৃঙ্গার বীভৎস হাস্য রৌদ্র বীর ভয়। করুণা অদ্ভুত শান্তি এই রস নয়।।
অদ্যরস সকল রসের মধ্যে সার। নায়িকা বর্ণিব অগ্রে তাহার আধার।।
নায়িকার স্বীয়াদি ভেদ
স্বীয়া পরকীয়া আর সামান্য বণিতা। অগ্রে এই তিন ভেদ পণ্ডিতবর্ণিতা।।
স্বীয়া নায়িকা
কেবল আপন নাথে অনুরাগ যার। স্বকীয়া তাহার নাম নায়িকার সার।।
নয়ন অমৃত নদী : সর্ব্বদা চঞ্চল যদি : নিজপতি বিনা কভু অন্য পানে চায় না।
হাস্য অমৃত সিন্ধু : ভুলায় বিদ্যুৎ ইন্দু : কদাচ অধর বিনা অন্য দিকে ধায় না।।
অমৃতের ধারা ভাষা : পতির শ্রবণে আশা : প্রিয়সখা বিনা কভু অন্য কানে যায় না।
নতি রতি গতি মতি : কেবল পতির প্রতি : ক্রোধ হলে মৌনভাব কেহ টের পায় না।।
মুগ্ধাদি ভেদ
মুগ্ধামধ্যে প্রগল্ভা তাহার ভেদ তিন। তিনেতে এ তিন ভেদ বুঝহ প্রবীণ।।
মুগ্ধা
মুগ্ধা বলি তারে যার অঙ্কুর যৌবন। বয়ঃসন্ধি সেই কাল বুঝ বিচঃক্ষণ।।
দেখিনু নাগরী : রূপের সাগরী : বয়সসন্ধি সময়।
শিশুগণ মিলি : রাঁধুবাড়ু খেলে :পুরুষে কিঞ্চিৎ ভয়।।
হংস খঞ্জরীটে : দেখি পদে দিঠে : কবে হল বিনিময়।
হৃদয়সরোজ : পূজিতে মনোজ : পণ্ডিতে হয় সংশয়।।
নবোঢ়া
এ যদি রমণে লাজে ভয়ে হয় স্তব্ধ। নবোঢ়া তাহাকে বলি প্রশ্রয়বিশ্রব্ধ।।
স্বকীয়া নবোঢ়া
হস্তেতে ধরিয়া : শয্যায় আনিয়া : যদি বা কোলে বসায়।
নানা বাক্যচ্ছলে : যত্নে কলে বলে : বাহিরে যাইতে চায়।।
নবোঢ়াকে বশ : করণ কর্কশ : সে রস কহিব কায়।
যেই পারা করে : স্থির করে ধরে : সেই জন ব্যামোহ পায়।।
পরকীয়া নবোঢ়া
আপনার পতি আছে : ভয়েতে না শুই কাছে : গায়ে হাত দেয় পাছে : এই ডরে ডরে হে।
প্রীতের বিষম কাজ : সে ভয়ে পড়িল বাজ : লাজে গলাইয়া লাজ : আশা বাসা করে হে।।
মুখের বাড়াও প্রীতি : হৃদয়ের হর ভীতি : তার পরে যেবা রীতি : রাখ রক্ষা কর হে।
যৌবন কমলাঙ্কুর : লোভে না করিও চুর : হিয়া কাঁপে দুরদুর : পাছে যাই মরে হে।।
সামান্য নবোঢ়া
কি ছার ধনের আসে : আইনু তোমার পাশে : আগে জানিতাম নাহি এত দায় হবে হে।
মুখ দেখি শোষে মুখ : বুক দেখি কাঁপে বুক : মনে হতে মন পড়ে কিসে প্রাণ রবে হে।।
কেবা ইহা সহিবেক : আমা হতে নহিবেক : ক্রুদ্ধ হও যদি নিজ ধন ফিরে লবে হে।
যেবা তীর্থে নাইলাম : তারি পুণ্য পাইলাম : অতঃপর ক্ষমা দেহ আমারে না সহে হে।।
বিশ্রব্ধ নবোঢ়া
স্তন দুটি করে ছ্যাঁদা : উরু দুটি ভুজে বাঁধা : লাজে ভয়ে মুদিল নয়ন।
প্রথমেতে নিরুত্তর :না না না তা : টাল টোল এখন তখন।।
যদি খেয়ে লাজ ভয় : কিঞ্চিত সঞ্চিত হয় : তবে আর না যায় ধারণ।
নবীন ভূষণ বাস : নব সুধা হাস বাস : নর রস কে করে গণন।।
মুগ্ধার ভেদ
মুগ্ধার প্রভেদ দুই করিয়া বর্ণনা। অজ্ঞাতযৌবনা আর বিজ্ঞাতযৌবনা।।
অজ্ঞাতযৌবনা
হয়েছে যৌবন যার নহে অনুভব। অজ্ঞাতযৌবনা তাকে বলে কবি সব।।
সখা সখী মেলি : ধাওয়াধাওয়ি লেলি : হারি কেহ যেন চোর।
অন্য দিনে ধাই : সবা আগে যাই : আজ কেন হারি মোর।।
নিতম্ব হৃদয় : ভারি হেন লয় : চক্ষু কর্ণে পড়ে জোর।
কটি দেখি ক্ষীণ : খসে পড়ে চীন : বাড়ে ঘাগরার ডোর।।
বিজ্ঞাতযৌবনা
নিজ নবযৌবন যে ব্যক্ত করে ছলে। বিজ্ঞাতযৌবনা তাকে কবিবর বলে।।
দেখিলাম ঘরে ঘরে : সকলে কাঁচলী পরে : নানা বর্ণে উড়ায় উড়ানি।
পরিহাস্যজন যত : নানা ছলে কহে কত : বাহিরায় হইল পোড়ানী।।
দেহের কি কব কথা : সকল শরীর ব্যথা : কত শত বিছার জ্বলনী।
তোরে বলি প্রিয় সই : লাজে কারে নাহি কই : পাছে জানে জনক জননী।।
মধ্যা
লজ্জা আর রতিআশা সমান যাহার। রসিক পণ্ডিতে কহে মধ্যা নাম তার।।
রতি রসে কৃতি পতি : মোরে ভালবাসে অতি : দেয় নিজাঙ্গুরী কণ্ঠমালা।
আঁখিআড়ে নাহি রাখে : সদা কাছে কাছে থাকে : সুখ বটে কিন্তু এক জ্বালা।।
নখাঘাত দেখি বুকে : দন্তচিহ্ন দেখি মুখে : সখি হাসে কর্ণে লাগে তালা।
শয্যা ঠেকি এই দোষে : না শুইলে পতি রোষে : শরীর হইল ঝালাপালা।।