- বইয়ের নামঃ দারোগার দপ্তর
- লেখকের নামঃ প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
খুন না চুরি
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। হাতের কাজ শেষ করিয়া অফিস–ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময়ে পশ্চিমদেশীয় একজন ভদ্র লোক আমার সম্মুখে আসিয়া নমস্কার করতঃ একখানি পত্ৰ দিলেন। পত্ৰখানি গ্ৰহণ করিয়া দেখিলাম, উহা আমারই উপরিতন কৰ্ম্মচারীর লেখা। খুলিয়া পাঠ করিলাম। ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোডে খুন হইয়াছে, আমাকে তখনই পত্রবাহকের সহিত তাহার তদ্বির করিতে যাইতে হইবে।
কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি দাঁড়াইয়া উঠিলাম। আগন্তুক আমার অভিপ্ৰায় বুঝতে পারিয়া পরম আপ্যায়িত হইয়া বলিলেন, আসুন মহাশয়! আমি ধনে প্রাণে মারা গেলাম। সকল কথা গাড়ীতেই শুনিতে পাইবেন।
দ্বিরুক্তি না করিয়া আমি তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাহির হইলাম। ফটকের সন্মুখেই তাঁহার গাড়ী ছিল, উভয়েই সেই গাড়ীতে উঠিলাম। কোচমান শকট চালনা করিল।
লোকটীর বয়স প্ৰায় পয়ত্ৰিশ বৎসর, দেখিতে অতি সুপুরুষ। বেশ হৃষ্ট–পুষ্ট দেহ। তাঁহার পরিধানে একখানি পাতলা দেশী কালাপেড়ে ধুতি, একটা আদ্ধির পিরাণ, একখানি মান্দ্ৰাজী জরিপেড়ে উড়ানি, মস্তকে একটা ফিরোজা রঙের পাগড়ী, গলায় গিনি সোণার মোটা হার, কৰ্ণে হীরাবসান ফুল, হস্তে হীরার আংটী, পায়ে বাৰ্ণিশ করা জুতা।
কিছুদূর যাইতে না যাইতে তিনি অতি বিমৰ্ষভাবে বলিলেন, মহাশয়, আমার সাৰ্ব্বনাশ হইয়াছে। আমার ভাবী–পত্নীকে কে খুন করিয়াছে।
ভাবী পত্নীর কথা শুনিয়া আমি বিস্মিত হইলাম, তাহার মুখের দিকে একদৃষ্টি চাহিয়া রহিলাম। তিনি আমার মনোগত ভাব বুঝিয়া বলিলেন, দুই বৎসর হইল আমার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তাঁহার মৃত্যুর পরে আমার একমাত্র পুত্রও মারা পড়ে। মনে করিয়াছিলাম, আর সংসারে লিপ্ত হইব না; কিন্তু বিধিলিপি অখণ্ডনীয়। ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোডে শোভন সিং নামে আমার এক বন্ধু বাস করিতেন। আমি প্রায়ই তাঁহার বাড়ীতে যাতায়াত কিরিতাম। শোভন সিংএর অবস্থা বড় ভাল ছিল না। তাঁহার একটী কন্যা ছিল। মেয়েটার বিবাহের বয়স উৰ্ত্তীর্ণ হইলেও অর্থঅভাবে তিনি বিবাহ দিতে পারেন নাই। কন্যার নাম রূপসী। তাহার বয়স প্ৰায় চৌদ্দ বৎসর, দেখিতে বেশ সুন্দরী। একদিন কথায় কথায় শোভন সিং কন্যার বিবাহের কথা উত্থাপন করেন এবং আমাকে বিবাহ করিবার জন্য অত্যন্ত অনুরোধ করেন। উদ্ধাপসী সুন্দরী যুবতী, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার, দু–পয়সার সঙ্গতিও আছে। আমিও পিতার একমাত্র সন্তান, বিবাহ না করিলেন বংশ লোপ হইবে, এই আশঙ্কায় বিবাহে সন্মত হইলাম। কিন্তু তাহার পর হইতে শোভন সিং আর বিবাহের কথা উত্থাপন করেন না দেখিয়া আমি তাঁহাকে বিবাহের দিন স্থির করিতে বলি। শোভন সিং আমার কথায় যেন বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, পাঁচশত টাকা না দিলে আমি রূপসীকে দান করিতে পারিব না।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, শোভন সিং কি পূৰ্ব্বে টাকার কথা বলেন নাই?
তিনি ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না, টাকার নামও করেন নাই। টাকা দিতে হইবে শুনিয়া আমার কেমন সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, হয় ত তিনি আর কোথাও পাত্র ঠিক করিয়াছেন। এখন টাকা চাহিয়া আমাকে তাড়াইবার চেষ্টায় আছেন। আমার তখন বিবাহে ইচ্ছা হইয়াছে। রূপসীও জানিতে পারিয়াছে যে, তাহার সহিত আমার বিবাহ হইবে। পূর্বের মত সে ও আর আমার কাছে অসিত না। কাজেই আমি সন্মত হইলাম। বলিলাম, আমি টাকা দিতে প্রস্তুত আছি। আপনি বিবাহের দিন স্থির করুন। তখনই একজন দৈবজ্ঞকে ডাকা হইল। তিনি আসিয়া আমাদের বিবাহের দিন ধাৰ্য্য করিয়া দিলেন। কিন্তু দুরদৃষ্ট বশতঃ সে লগ্নে আমাদের বিবাহ হইল না।
আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কেন?
তিনি বলিলেন, বিবাহের দুই দিন পূর্বে শোভন সিংএর এক জ্ঞাতি বিয়োগ হয়। কালাশৌচ, কাজেই বিবাহ হইল না। অশৌচান্তে আবার দিন স্থির হইল। কিন্তু সেবারও বিবাহ হইল না। রূপসীর সাংঘাতিক জর হইল। প্ৰায় তিন মাস ভুগিয়া রূপসী আরোগ্যলাড করিল। এইরূপে আরও তিন চারিবার দিন ধার্য্য হইল, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে তখনও বিবাহ হইল না। কোন না কোনো অছিলা করিয়া শোভন সিং বিবাহের দিন ক্রমাগত পিছাইয়া দিতে লাগিলেন। প্ৰায় আট মাস কাল এইরূপে অতিবাহিত হইল। পরে একদিন শোভন সিং বলিলেন যে, রূপসী ও বাড়ীর অন্যান্য লোকের চিকিৎসায় তাহার অনেক অর্থব্যয় হইয়া গিয়াছে। যদি আমি আরও তিন শত টাকা দিই, তাহা হইলে আমাদের শীঘ্রই বিবাহ হইতে পারে। আমি তখন অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছি। কাজেই শোভন সিংএর প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। বোধ হয় তিনি ভাবিয়াছিলেন, আমি আর অধিক টাকা দিতে স্বীকৃত হইব না। কিন্তু যখন আমি তাহাতেও সম্মত হইলাম, তখন তিনি আন্তরিক বিরক্ত হইলেন। মুখে বলিলেন, সমস্ত টাকা অগ্রিম দিলেই বিবাহ হইবে। আমিও নাছোড় বান্দা, পরদিনই আটশত টাকা আনিয়া শোভন সিংএর হস্তে দিলাম। তিনি আনন্দিত মনে উহা গ্রহণ করিলেন, কিন্তু কোন রসিদ দিলেন না, আমিও চক্ষু লজ্জায় পড়িয়া কোন রসিদ চাহিলাম না। তবে যখন টাকা, দিই, সেই সময়ে সেখানে তিন চারিজন লোক ছিলেন। তাঁহারাই সাক্ষী স্বরূপ ছিলেন। সে যাহা হউক, টাকা পাইয়া শোভন সিং আবার বিবাহের দিন স্থির করিলেন। আজই সেই দিন। বেলা পাঁচটার সময় আমি কয়েকজন মাত্র বরযাত্ৰ লইয়া কন্যার গৃহে উপস্থিত হইলাম। বাড়ীতে প্ৰবেশ করিবামাত্র একটা ভয়ানক গোলযোগ আমার কর্ণগোচর হইল। ক্ৰমে চীৎকার, ক্ৰন্দনধ্বনিও শুনিতে পাইলাম। মনে একটা কেমন আতঙ্ক উপস্থিত হইল। আমার সঙ্গীগণ দেখিয়া শুনিয়া অবাক হইলেন। বর বা বরযাত্র বসিবার স্থান পৰ্য্যন্ত করা হয় নাই। কি করিব, কোথায় বসিব ভাবিতেছি, এমন সময়ে শোভন সিং কাঁদিতে কাঁদিতে আমাদের নিকটে আসিলেন। বলিলেন, রূপসীকে কে খুন করিয়াছে। ক্ৰন্দনের শব্দ শুনিয়া প্রতিবেশিগণ ছুটিয়া আসিল, বাড়ীতে লোকে লোকারণ্য হইল। রূপসীর মৃত্যু–সংবাদে দুঃখ হওয়া দূরে থাক, আমার অত্যন্ত ক্ৰোধ হইল। আমি অতি কৰ্কশ স্বরে বলিলাম, চলুন–আমি মৃতদেহ দেখিতে চাই। কেমন করিয়া কেই বা রূপসীকে খুন করিল, আপনিই বা এখনও থানায় এ সংবাদ দেন নাই কেন? আমি বড় ভাল বুঝিতেছি না। ইহার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনরূপ ষড়যন্ত্র আছে। রূপসী যদি সত্য সত্যই খুন হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমি আপনাকে সহজে ছাড়িব না। এই দণ্ডে আমার আটশত টাকা চাই।