- বইয়ের নামঃ মন পবন
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১-০৫. সেই মুখখানা যেন আজও
মন পবন – কিরীটী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
সেই মুখখানা যেন আজও ভুলতে পারিনি।
সত্যি, এমন এক একটি মুখ এক এক সময় আমাদের চোখে পড়ে যা কখনও বুঝি মনের পাতা থেকে মুছে যায় না।
সে মুখের কোথায় যেন এক বিশেষত্ব মনের পাতায় গভীর আঁচড় কেটে যায়।
এবং সেই মুখখানা যখনই মনের পাতায় ভেসে উঠেছে, তখনই মনে হয়েছে কেন এমন হল? শেষের সেই বিয়োগান্ত দৃশ্যের জন্য দায়ী কে?
কিরীটীর মতে অবিশ্যি সেই বিচিত্র শক্তি, যে শক্তি অদৃশ্য, অমোঘ সেই নিয়তি, নিষ্ঠুর নিয়তিই দায়ী।
কিন্তু তবু আমার এক এক সময় মনে হয়েছে সত্যি কি তাই, পরক্ষণেই আবার মনে হয়েছে তাই যদি না হবে তো এমনটাই বা ঘটে কেন?
ঘটেছে কেন?
থাক, যার কথা আজ বলতে বসেছি তার কথাই বলি।
.
কিস্তি।
কথাটা বলে কিরীটী হাত তুলে নিল।
দেখলাম শুধু কিস্তিই নয়, মাত।
পর পর তিনবার মাত হলাম এইবার নিয়ে এবং ব্যাপারটা যে সুখপ্রদ হয়নি সেটা বোধ হয় আমার মুখের চেহারাতেই প্রকাশ পেয়েছিল।
এবং কিরীটীর নজরেও সেটা এড়ায়নি, প্রকাশ পেল তার কথায় পরক্ষণেই।
বলল, কি রে, একেবারে যে চুপশে গেলি! মাত হয়েছিস তো আমার হাতে–
অদূরে সোফায় বসে কৃষ্ণা একটা নভেল পড়ছিল। এবং এতক্ষণ আমাদের খেলার মধ্যে একটি কথা বলেনি বা কোন মন্তব্য প্রকাশ করেনি।
কিরীটীর ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণে সে কথা বললে, হ্যাঁ, কিরীটী রায় যখন তখন মাত হওয়াটাও তো তোমার গৌরবেরই সামিল হল ঠাকুরপো তার হাতে।
কিরীটী দেখলাম তার স্ত্রীর দিকে একবার আড়চোখে তাকাল মাত্র কিন্তু কথা বলল।
কৃষ্ণা স্বামীর আড়চোখের দৃষ্টি লক্ষ্য করেও যেন লক্ষ্য করেনি এমনি ভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললে, তবে তোমাকে একটা সংবাদ দেওয়া কর্তব্য বলে বোধ করছি, ভদ্রলোক নিজেও এবারে মাত হয়েছেন।
কিরীটী তার ওষ্ঠধৃত পাইপটায় একটা কাঠি জ্বেলে পুনরায় অগ্নিসংযোগে উদ্যত হয়েছিল, হঠাৎ তার উদ্যত হাতটা থেমে গেল এবং স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললে, কি বললে?
বললাম আপনিও এবারে মাত হয়েছেন!
কথাটা বলে যেন একান্ত নির্বিকার ভাবেই কৃষ্ণা নভেলের পাতায় আবার মনঃসংযোগ করল।
মাত হয়েছি?
হুঁ।
পূর্ববৎ সংক্ষিপ্ত জবাব।
মানেটা যদি বুঝিয়ে বলতে সখি!
মানে?
হুঁ।
সে তো অতিশয় প্রাঞ্জল, বেচারী নির্মলশিব সাহেব না বুঝতে পারলেও আমার কিন্তু বুঝতে দেরি হয়নি।
কি, ব্যাপার কি বৌদি? আমি এবার প্রশ্নটা না করে আর পারলাম না। কিরীটী মাত হয়েছে, বেচারী নির্মলশিব সাহেব
এতক্ষণে কিরীটী হো হো করে হেসে ওঠে।
এবার আমি কিরীটীকেই প্রশ্ন করি, ব্যাপার কি রে?
জ্বলন্ত পাইপটায় একটা সুখটান দিয়ে কিরীটী বললে, তোকে বলা হয়নি সুব্রত, গত এক মাস ধরে নির্মলশিব সাহেব আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
তা যেন বুঝলাম, কিন্তু নির্মলশিব সাহেবটি কে?
মনে নেই তোর, সেই যে কি আশ্চর্য নির্মলশিব সাহেব! একদা ব্যারাকপুর থানার ও. সি. ছিল, বছর দুই হল হেড কোয়ার্টারে বদলি হয়ে এসেছে।
এতক্ষণে আমার মনে পড়ে।
এবং সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের চেহারাটিও মনের পাতায় ভেসে ওঠে।
.
মোটাসোটা নাদুসনুদুস নাড়ুগোপাল প্যাটার্নের হুড়িয়াল সেই ভদ্রলোক।
এবং দেহের অনুপাতে পদযুগল যার কিঞ্চিৎ ছোট এবং চৈনিক প্যাটার্নের বলে বাজারের যাবতীয় জুতোই যার পায়ে কিছুটা সর্বদাই বড় হত!
যার প্রতিটি কথার মধ্যে বিশেষ মুদ্রাদোষ ছিল, কি আশ্চর্য!
বললাম, হঠাৎ সেই নির্মলশিব সাহেব তোকে গত এক মাস ধরে অতিষ্ঠ করে তুলেছে মানে?
বলিস না আর তার কথা। আমিও শুনব না, সেও শোনাবেই।
কৃষ্ণা ঐসময় টিপ্পনী কেটে বলে ওঠে, অত ভণিতার প্রয়োজন কি? কেউ কোন কথা দশ হাত দূরে বসে বললেও যার ঠিক ঠিক কানে যায়, সে ঐ ভদ্রলোকের কথা শোনেনি এ কথাটা আর যেই বিশ্বাস করুক ঠাকুরপোও বিশ্বাস করে না—আমিও করি না। কিন্তু সত্যি কথাটা বলতেই বা অত লজ্জা কিসের! কেন বলতে পারছ না, শুনে বুঝতে পেরেছ, রীতিমত জটিল ব্যাপার, শেষ পর্যন্ত মাত হবে তাই শুনেও না শোনার ভান! এড়িয়ে যাবার অছিলা করছ একমাস ধরে!
তাই, সখি, তাই। পরাজয় স্বীকার করছি, হার মানছি। কিরীটী বলে ওঠে।
হ্যাঁ, তাই স্বীকার কর, তাই মান।
বললাম তো, তোমার কাছে হার মানি সেই তো মোর জয়। কিরীটী হাসতে হাসতে আবার বলে।
কথা বললাম এবার আমি।
কিন্তু কি ব্যাপারটা রে?
কে জানে কি ব্যাপার! বলছিল—
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শোনা গেল।
সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে, সে বলে, ঐ যে এসে গিয়েছেন জুতো!
হ্যাঁ রে, মনে নেই তোর, নির্মলশিব সাহেবের জুতো সম্পর্কে তার অধীনস্থ কর্মচারীদের সেই বিখ্যাত রসিকতাটা? কে যায়। জুতো, কার? না ভুড়ির। ভুড়ি কার? নির্মলশিব সাহেবের। সাহেব কোথায়? আর একটু উপরে
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সত্যি সত্যি নির্মলশিব সাহেবই ঘরে এসে প্রবেশ করল।
এবং ঘরে ঢুকেই আমার মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইল।
তারপরই হঠাৎ জ্ব সোজা হয়ে এল এবং সহাস্যমুখে বলে ওঠে, কি আশ্চর্য! আরে সুব্রতবাবু না?