- বইয়ের নামঃ কৃষ্ণা কাবেরী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১. ইস্পাতের তৈরী ছোরাটা
কৃষ্ণা কাবেরী
ইস্পাতের তৈরী ছোরাটা।
ছোরার ফলাটা ক্রমে সরু হয়ে অগ্রভাগটা তীক্ষ্ণ, অত্যন্ত ধারালো; ছোরার বাঁটটা সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত চন্দনকাঠের তৈরী! সুমিগ্ধ পাতলা একটা চন্দনের গন্ধ ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে!
দুটি চেয়ারে মুখোমুখি বসে সি. আই. ডি-র ইন্সপেক্টার মজিবুর রহমান ও কিরীটী রায়। সামনেই একটা ছোট শ্বেতপাথরের টেবিলের উপরে অয়েল পেপারের উপরে রক্ষিত ছোরাটা।
কিরীটী প্রশ্ন করে, তারপর?
তারপর সকালে ভৃত্য মধুই নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষে ঢুকে প্রথম দেখতে পায়, নরেন মল্লিকের অসাড় প্রাণহীন দেহটা ডেক-চেয়ারটার ঠিক সামনেই, মেঝের কার্পেটের উপরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে এবং বাম দিককার বুকে ঐ ছোরাটা সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে। গায়ে তখনও তার স্লিপিং গাউনটা পরা! The dagger pierced through and through the heart!
হুঁ! যে-ই নরেন মল্লিককে ছোরা দিয়ে হত্যা করে থাকুক আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে লোকটা হাতে প্রচুর শক্তি রাখে! আচ্ছা স্লিপিং গাউনটা তখনও নরেন মল্লিকের গায়েই ছিল বলছিলেন ইনসপেক্টার, ঘরের শয্যাটা পরীক্ষা করা হয়েছিল কি?
হাঁ। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি শয্যাটা, রাত্রে ব্যবহৃত হয় নি। এমন কি প্রতি রাত্রে নাকি শয়নের পূর্বে নরেন মল্লিকের এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল পান করা অভ্যাস ছিল, মধুর সে রাত্রে রাখা শিয়রের সামনে ত্রিপয়ের উপরে রক্ষিত জলভর্তি গ্লাসটা পর্যন্ত ঠিক তেমনই ছিল। রাত্রি দশটায় নিজে সে গ্লাসটা জলভর্তি করে রেখে এসেছিল। ময়না তদন্তের রিপোর্টেও তাহলে মৃত্যুর কারণ ছুরিকাঘাতই—
অন্য কোন নিদর্শনই পাওয়া যায় নি?
না।
কিরীটী সম্মুখের টেবিলের ওপরে রক্ষিত অয়েল পেপারের উপর থেকে ছোরাটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। ইস্পাতের তৈরী মজবুত ছোরা। ওজনেও মন্দ হবে না। অগ্রভাগটা ধারালো ও তীক্ষ্ণ।
হঠাৎ মজিবুর রহমান বলে, কিন্তু আশ্চর্য কি জানেন মিঃ রায়, ছোরার বাঁটে কোন আঙ্গুলের ছাপই পাওয়া যায় নি।
কিরীটী তখনও ছোরাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল, মৃদু কণ্ঠে বলে, স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক!–বিস্মিত রহমান কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, তা বই কি! প্রথমতঃ ছোরার বাঁটে কোন আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গেলে সর্বাগ্রে নিশ্চয়ই সে কথা আপনি আমাকে বলতেন। দ্বিতীয়তঃ অমন কৌশলের সঙ্গে যে খুন করতে পারে, ছোরার বাঁটে সে তার আঙ্গুলের ছাপ রেখে যাবে এমন ভাবাই তো অন্যায়! আর এসব ক্ষেত্রে by chance আঙ্গুলের কোন ছাপ পাওয়া গেলেও সেটা হত্যাকারীর কখনো হয় না, বরং যে নিহত হয় অনেক সময় তারই আঙ্গুলের ছাপ বা হাতের ছাপ পাওয়া যায়। কিন্তু সে কথা যাক। মৃতের কক্ষে হত্যার সূত্র বা প্রমাণ হিসেবে তার বক্ষে বিদ্ধ এই ছোরাখানি ছাড়া আর কিছুই তাহলে পাওয়া যায় নি বা নজরে পড়ে নি আপনাদের? যেমন ধরুন, কোন struggleয়ের চিহ্ন বা—
না। So far সবই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখা হয়েছে, but nothing more could be detected.
হুঁ।
এর পর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকে।
হঠাৎ আবার কিরীটীই ডাকে, মিঃ রহমান?
বলুন?
সেই ঘরটা, মানে পার্ক সার্কাসে মৃত নরেন মল্লিকের বাড়িতে যে কক্ষে তাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়, সেই ঘরটা কি এখনো আপনাদের disposalয়েই আছে?
হাঁ নিশ্চয়ই! তদন্ত এখনো চলছে, করোনার্স কোর্টে বিচার এখনও শেষ হয় নি। নরেন মল্লিক নিহত হয়েছে গত ২৭শে পৌষ সোমবার—আর আজ বৃহস্পতিবার, মাত্র তিন দিন আগে।
বেশ। তাহলে আজ এখুনি যদি আপনার অসুবিধা না হয় চলুন না, আর একটিবার সেই ঘরটা দুজনে ভাল করে দেখে আসা যাক। আর সেই সঙ্গে বাড়ির লোকদেরও দু-চারটে কথা জিজ্ঞাসা করে আসা যাবে।
বেশ তো! আপত্তি কি, চলুন!
তবে আর দেরি নয়—শুভস্য শীঘ্র—চলুন ওঠা যাক।
ইন্সপেক্টার মিঃ রহমানের গাড়িতে চেপেই কিরীটী ও রহমান সাহেব রওনা হলো পার্ক সার্কাসে নরেন মল্লিকের বাড়ির দিকে অতঃপর। এবং গাড়িতে বসেই একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে ধূমপান করতে করতে হঠাৎ এক সময় কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা রহমান সাহেব, আপনি বলছিলেন নরেন মল্লিক বহুদিন বর্মা মুন্নকে ব্যবসা করেছেন। এবং মাত্র এক বৎসর আগে যদি তিনি হঠাৎ ব্যবসা গুটিয়ে দিয়ে এসে থাকেন, কেন এলেন? আর শুধু তাই নয়, এক বৎসরের মধ্যেই খুনও হলেন নৃশংস ভাবে। কিন্তু কেন, কেন
আপনার কথাটা ঠিক আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়!
মানে, বলছিলাম তার অর্থাৎ মল্লিকের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে একটা details পেলে আমাদের তদন্তের সুবিধা হতো না কি?-অনেক সময় দেখা গিয়েছে এ সব ঘটনার পিছনে থাকে অনেক ব্যক্তিগত ব্যাপার জড়িত হয়ে।
সৌভাগ্যক্রমে খুনের পরের দিন সকালে তদন্তের সময়ই নরেন মল্লিকের এক পুরাতন বন্ধু, অ্যাড়ভোকেট সমীর রায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনিই বলেছিলেন, নরেন মল্লিক তার বহুকালের বন্ধু এবং নরেন মল্লিক হঠাৎ চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে এসে তারই বাড়িতে নাকি সর্বপ্রথম ওঠেন।
.
এক দিন সকালে ঠিক আজ থেকে এক বছর আগে।