- বইয়ের নামঃ আলোকলতা
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১. আমন্ত্রণটা জানাল এবার মণিকা
আমন্ত্রণটা জানাল এবার মণিকাই।
পৃথক পৃথক ভাবে মণিকা পত্র দিল তার প্রিয় তিন বন্ধু অতুল, রণেন ও সুকান্তকে।
এবারে পূজার ছুটিতে এস বেনারস, কাশী। কাশীতে দিদিমার বাড়িতে ছুটিটা এবারে কাটানো যাবে।
আপত্তি আর কি থাকতে পারে। প্রত্যেকবারই পূজায় ছুটির কয়েকটা দিন চারজনে মিলে কোথাও না কোথাও গিয়ে হৈ হৈ করে কাটিয়ে আসে।
গতবার গিয়েছিল ওরা লক্ষ্ণৌ, তার আগের বার শিলং। এবারে না হয় কাশীই হোক।
জায়গাটা তো আর বড় কথা নয়। সকলে মিলে কয়েকটা দিনের জন্য এক জায়গায়। একত্রে মিলিত হয়ে হৈ হৈ করে আনন্দ করা। তা সে লক্ষ্ণৌই হোক, শিলংই হোক বা কাশীই হোক—এমন কি পাতাল বলে সত্যি যদি কিছু থাকত সেখানে যেতেও আপত্তি ছিল না। অবিশ্যি কাশীতে মণিকার দিদিমার ওখানে ছুটি কাটানো যে এই প্রথম তা নয়।
বছর তিনিকে আগে একবার পূজাবকাশটা ওরা কাশীতে মণিকাদের ওখানেই কাটিয়েছিল এবং সেবারে বেশ কিছুদিনই কাশীতে ওরা থেকেছিল।
তার কারণও অবশ্য একটা ঘটেছিল।
ছুটির মাঝামাঝি হঠাৎ মণিকা অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে সামান্য অল্প অল্প জ্বর—কিন্তু তিন-চারদিনেও সেই অল্প অল্প জ্বর যখন গেল না এবং ক্রমে জ্বরের সঙ্গে দু-একটা করে
উপসর্গ দেখা দিতে লাগল তখন সকলেই চিন্তিত হয়ে ওঠে।
শেষ পর্যন্ত রোগটা গিয়ে টাইফয়েডে দাঁড়ায় এবং পুরো এক মাস লাগে মণিকাকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে।
কাজেই দশ-পনের দিনের জায়গায় মাসখানেকের কিছু উপরেই সকলকে থাকতে হয়েছিল কাশীতে সেবারে।
এ ছাড়াও মধ্যে মধ্যে যে সকলেরই কাশীতে মণিকাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল না, তাও নয়।
.
মণিকার দিদিমা ছিলেন কাশীতে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কাশীবাসিনী। মণিকারও ত্রিসংসারে ঐ এক বুড়ী দিদিমা ছাড়া আপনার জন বলতে কেউ ছিল না।
মণিকা এম.এ. পাশ করে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে কলকাতাতেই থাকে। অথচ বুড়ী দিদিমাকে সর্বদা কাশীতে দেখাশোনা করবারও একজন কারও দরকার। বুড়ী দিদিমার জন্য মণিকার সর্বদাই একটা দুশ্চিন্তা।
কাশীতে অবিশ্যি সেরকম স্ত্রীলোকর অভাব ছিল না, কিন্তু দিদিমার খুঁতখুঁতে মন, কাউকেই তেমন পছন্দ হয় না।
এমন সময় দেশের গ্রাম থেকে নিরাশ্রয়া সুবালা গ্রামের একদল তীর্থযাত্রীর সঙ্গে তীর্থপর্যটন করতে করতে কাশীতে এসে উঠল মণিকাদেরই বাড়িতে।
সুবালা ব্রাহ্মণের মেয়ে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের বেশী নয়।
সুবালা অভাগিনী। ছোটবেলায় মা-বাপকে হারায়। মামা-মামীর কাছেই মানুষ। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়াও কিছু শিখেছিল এবং মামা-মামীর চেষ্টাতেই একপ্রকার নিখরচায়ই এক মেধাবী ছাত্রের সঙ্গে বিবাহও হয়েছিল সুবালার। মেধাবী ছাত্রটি সুবালার রূপে মুগ্ধ হয়েই স্বেচ্ছায় বিবাহ করেছিল সুবালাকে।
শুধু রূপসী বললেই সুবালা সম্পর্কে যেন সবটুকু বলা হয় না। আগুনের মত রূপ ছিল সুবালার। প্রখর সে রূপের জৌলুসে পুরুষ তো ছার, মেয়েদের চোখই ঝলসে যেত। কিন্তু বিনা পণে বিবাহের বাজারে রূপের জৌলুসে বিকিয়ে গেলেও সুবালার স্বামীভাগ্য ছিল না। তাই বিবাহের পর ছমাস না যেতেই সুবালা হাতের নোয়া ও সিঁথির সিঁদুর মুছে মামা-মামীর কাছে ফিরে এল।
এবং দুভাগ্য যখন আসে একা আসে না—মামার গৃহে ফিরে আসবার মাসখানেকের মধ্যেই মামা গেলেন মারা।
সুবালা শীঘ্রই সংসারে সকলের চক্ষুশূল হয়ে উঠল। দুঃখের অপমানের অন্ন তিক্ত হতে তিক্ততর হয়ে উঠতে লাগল সুবালার মুখে দিন যত যায়।
মৃত্যু-আকাঙক্ষায় রাত্রি ও দিনের মুহূর্তগুলো কাটতে লাগল।
এমনি করে অনেকগুলো বছর কেটে গেল বৈধ্যবের। তারপর একদিন গ্রামের একদল প্রবীণা তীর্থযাত্রীর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে এসে কাশীতে মণিকার দিদিমার ওখানে উঠল সুবালা।
তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী সুবালা অতি সহজেই মণিকার দিদিমার স্নেহকে জয় করে নিল। ফলে যাবার সময় সকলে ফিরে গেল, কিন্তু সুবালা থেকে গেল মণিকার দিদিমার ওখানেই। সেও আজ বছর পাঁচেকের কথা।
সুবালাকে পেয়ে মণিকার দিদিমাও নিশ্চিন্ত হলেন এবং মণিকাও দিদিমা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হল।
রান্না ও গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ সুবালা তো করেই, অবসর সময় ভাগবত রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি পড়ে শোনায় বুড়ী দিদিমাকে।
সুবালার অল্প বয়স ও আগুনের মত রূপ দেখে প্রথমটায় মণিকার বুড়ী দিদিমা মনে মনে একটু ইতস্তত করেছিলেন সুবালাকে গৃহে স্থান দেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে কিনা।
কিন্তু দেখা গেল বয়স অল্প ও আগুনের মত রূপ থাকলেও সুবালার চরিত্রে একটা সংযত আভিজাত্য আছে ও সেই সঙ্গে আছে একটা অদ্ভুত নিষ্ঠার ও তীক্ষ্ণ মর্যাদাবোধ। ছ্যাবলা নয়, অত্যন্ত সংযমী। ধীর-স্থির।
নিশ্চিন্ত হলেন মণিকার বুড়ী দিদিমা।
সুবালার চরিত্রে আর একটি গুণ ছিল, আলসেমিকে সে কখনও এতটুকু প্রশ্রয় দিত। সাংসারিক কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে সময়টা সুবালা বই পড়ে অথবা উলের বা সেলাইয়ের কাজ করে কাটাত।
পাড়ার গৃহস্থদের উলের সেলাইয়ের কাজ করে সুবালা দুপয়সা বেশ উপার্জনও করত।
.
কাশীতে মণিকার দিদিমার বাড়িটা জঙ্গমবাড়ির একটা গলির মধ্যে। সেকেলে ধরনের তিনতলা পুরাতন বাড়ি। বাড়িটা বছর পনের-ষোল আগে চাকরিতে অবস্থানকালেই মণিকার দাদু কাশীশ্বর চৌধুরী কিনেছিলেন একটা মৌকায় মাত্র পাঁচ হাজারে।