- বইয়ের নামঃ শিখণ্ডী খণ্ড
- লেখকের নামঃ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আরোহী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
শিখণ্ডী খণ্ড – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
উৎসর্গ : আমার পরম শুভানুধ্যায়ী পাঞ্চালী গুহকে
.
সূচিমুখ
- শিখণ্ডী খণ্ড
- অস্পৃশ্যনামা
- মৃত্যুদণ্ড : রাষ্ট্র কর্তৃক নরমেধ যজ্ঞ
.
মুখবন্ধ
‘শিখণ্ডী খণ্ড’ গ্রন্থটিতে তিনটি প্রমাণ আকারের প্রবন্ধ নিয়ে সংকলিত হয়েছে। এমন তিনটি বিষয় নিয়ে প্রবন্ধগুলো লেখা হয়েছে, মানুষের কৌতূহল সীমাহীন। মানুষের সেই কৌতূহলের পিপাসা মেটাতেই এই তিনটি প্রবন্ধ রচনার মূল উদ্দেশ্য। বিষয় তিনটি হল –শিখণ্ডী খণ্ড, অস্পৃশ্যনামা এবং মৃত্যুদণ্ড।
‘শিখণ্ডী খণ্ড’ প্রবন্ধের বিষয় এলজিবিটি (LGBT)। অর্থাৎ তথাকথিত হিজড়া, রূপান্তরকামী, সমকামী জন্ম, মৃত্যু, উৎসব, ধর্ম, জীবন, যৌবন ও যৌনতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। হিন্দুসমাজে তথাকথিত হিজড়ারা ব্রাত্য, ঘৃণ্য, প্রান্তিক। তাঁদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। এঁদের নিয়ে খিল্লি করা যায়, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা যায়। এঁরা হাসির খোরাক। তাই এঁরা সমাজের মূল্যস্রোতকে এড়িয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে নিজস্ব কমিউনিটিতে। সমাজবিজ্ঞানী অ্যান ওকলের মতে, ‘জৈবিক লিঙ্গ’ শারীরিক বৈশিষ্ট্য বহন করে। আর ‘মানসিক লিঙ্গ’ একটি নির্দিষ্ট সমাজে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত বিশিষ্ট নির্দেশ করে। একজন নারী ও পুরুষের কার কী রকম পোশাক-পরিচ্ছদ হবে; কে কী রকম আচার-আচরণ করবে; আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা কার কী রকম হবে; সমাজের নানা ধরনের কাজে একজন নারী বা একজন পুরুষের ভূমিকা কী হবে এই বিষয়গুলো নির্ধারণ করে জেন্ডার বা লিঙ্গ। অর্থাৎ, ‘জৈবিক লিঙ্গ’ বিষয়টি পুরোপুরি শরীরের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু মানসিক লিঙ্গ নির্ভরশীল সমাজের উপর।
অনেকে মনে করেন সমকামিতা স্বাভাবিক ও সৃষ্টিশীল নয়, তাই ওরা সমাজের ব্রাত্য। যৌন-অভিমুখিতা নির্ধারণে যে সন্তানপালন বা শৈশবের অভিজ্ঞতার কোনো ভূমিকা আছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আচরণের প্রভাবক হিসাবে এক পরিবেশে থাকার ভূমিকা মহিলাদের ক্ষেত্রে নগণ্য এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে শূন্য। কেউ কেউ সমকামী যৌনাচরণকে অপ্রাকৃতিক মনে করলেও বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা গেছে সমকামিতা মানব যৌনতার একটি সাধারণ ও প্রাকৃতিক প্রকার মাত্র এবং অন্য কোনো প্রভাবকের অস্তিত্ব ছাড়া এটি মনের উপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। অধিকাংশ মানুষের অভিজ্ঞতায় যৌনতার ব্যাপারে সচেতন পছন্দের কোনো ভূমিকা থাকে না। যৌন অভিমুখিতা পরিবর্তনের বিভিন্ন কর্মসূচির কার্যকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। এরকম অনেক অজানা তথ্য উপস্থাপনার মধ্য দিয়েই এই প্রবন্ধ।
‘অস্পৃশ্যনামা’ প্রবন্ধে আলোচনা হয়েছে ভারতীয় নিম্নবর্গীয় গোষ্ঠী তথা শূদ্র তথা দলিতদের কথা। ব্রাহ্মণবাদীদের অত্যাচার ও ঘৃণা নিয়ে একটি গোষ্ঠীর ইতিহাস। নারদ ‘বিষ্ণুসংহিতা’ গ্রন্থে ব্রাহ্মণদের অবধ্য ও শারীরিক শাস্তিভোগের অতীত বলেছেন। গুপ্তযুগেই পুরোহিত শ্রেণি ভগবানের প্রতিনিধি হয়ে গেলেন। সেই কারণেই তাঁদের সাত খুন মাফ। সেইসঙ্গে রাজারাও যে ভগবানের প্রতিনিধি ও দৈবশক্তিসম্পন্ন, সেটাও প্রচার হতে থাকল। সেটা নথি হিসাবে মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ে সংযোজিত হয়। বিষ্ণুসংহিতাতে বলা হয়েছে, “নিম্নশ্রেণির মানুষ উচ্চশ্রেণির মানুষের আসনে বসলে সেই নিম্নশ্রেণির নিতম্বে আগুনের ছাপ দিয়ে নির্বাসিত করে দেবে।” শূদ্রদের উদ্দেশ্যে আরও বলা হয়েছে –“সে যদি থুতু ফেলে তাঁর ঠোঁট কেটে দেবে।” বলা হয়েছে– “শূদ্র জাতিচ্যুত, তাই কোনো জাতিচ্যুত ব্যক্তি সাক্ষীরূপে গৃহীত হবে না।”
ঋগবেদের যুগেই যে চারটি বর্ণের উৎপত্তি হয়েছিল তার বীজ বা প্রমাণ পুরুষ সুক্ত (১০/৯০)। সেখানে দ্বাদশ ঋকে আছে পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ হল, দুই বাহু বা হাত থেকে রাজন্য হল, দুই ঊরু থেকে বৈশ্য হল এবং দুই চরণ বা পা থেকে শূদ্র হল— “লোকানান্তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহুরুপাদতঃ।/ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশং শূদ্রঞ্চনিরবর্তয়ৎ।।” মুসলিম শাসনের প্রায় ৮০০ বছরে এই ভারত উপমহাদেশে জাতপাত নিয়ে বহু জলঘোলা হয়েছে। জাতপাতের ঘৃণা থেকে মুক্তি পেতে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষগুলো বারবার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। ধর্মান্তরিত হয়েছে। গোষ্ঠী বদল করেছে। জাতপাতের ইস্যু নিয়ে মুসলিম শাসন চলাকালীনই উত্থান হয়েছে ব্রাহ্মসমাজ, বৈষ্ণব আন্দোলন, খ্রিস্টান বা মিশনারিদের।
ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ঠিক যেভাবে হিন্দু নিম্নবর্গীয়দের ঘৃণ্য ও অচ্ছুৎ ভাবত, ঠিক সেই সূত্রেই মুসলিম হয়ে যাওয়া নিম্নবর্গীয়দের ঘৃণ্য ও অদ্যুৎ করল। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তথাপি নিম্নবর্গীয়দের যথাযথ সম্মান জানিয়ে ফিরিয়ে আনার ন্যূনতম চেষ্টা করেনি। সেদিন যদি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ব্রাহ্মণ্যবাদে কিঞ্চিৎ শিথিলতা এনে নিম্নবর্গীয়দের যথাযোগ্য সম্মান না জানাতে পারত, তাহলে কখনোই এত সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায় থেকে মানুষ ইসলাম ও বৌদ্ধধর্মে কনভার্ট হয়ে যেত না।